তাদের টার্গেট বঙ্গবন্ধু, তাদের টার্গেট বাংলাদেশ
তাদের লক্ষ্য একটাই, এই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। একাত্তরে পাকিস্তানিদের পরাজয় তারা মানতে পারেনি, প্রভুদের পরাজয় মানতে পারেনি। ওই প্রভুদের পরাজয় মানতে পারেনি বলেই তাদের টার্গেটটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, টার্গেট বাংলাদেশ...
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। আওয়ামী লীগের চারবারের সাংগঠনিক সম্পাদক। জয়পুরহাট- ২ আসন থেকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে দায়িত্ব পেয়েছেন সরকারদলীয় হুইপ হিসেবে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে উঠে এসেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন দলীয় রাজনীতির বিভিন্ন চিত্র, বিরোধীপক্ষের ষড়যন্ত্র এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে তার নিজস্ব ভাবনা। আলোচনায় উঠে এসেছে সংসদীয় রাজনীতির অংশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ভাবনাও। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি থাকছে আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমানউল্লাহ আমান।
ঢাকা পোস্ট : আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখি, সব বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কি অগণতান্ত্রিক, নাকি আওয়ামী লীগ নেতারা দায়িত্ব নিতে চান না?
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন : আওয়ামী লীগের নেতারা দায়িত্ব নিতে চান না, বিষয়টা এমন নয়। রাষ্ট্রপরিচালনায় যে অভিজ্ঞতা, সেটা আমাদের সবার চেয়ে তার (প্রধানমন্ত্রী) বেশি এবং তিনি যে জায়গাটায় বসে আছেন সেখানে তার মেসেজ পাওয়ার সুযোগটাও বেশি। আমি হয়তো একটা কর্নার থেকে মেসেজ পাচ্ছি, আমার দলের অনেক নেতা হয়তো অরেকটা কর্নার থেকে মেসেজ পাচ্ছেন। সেই মেসেজগুলো সব সত্য নাও হতে পারে। মেসেজদাতারা তাদের মতো করে মেসেজ দেন। তারা তাদের মতো করে সত্যটা দেখেন। তিনি যখন আমাকে মেসেজ দিচ্ছেন আমরা চেষ্টা করি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সব মেসেজ পাঠাতে।
আজ বাংলাদেশে ভাস্কর্য নিয়ে যদি তুলকালাম কিছু হয়, ফলে যে মিস ব্র্যান্ডিংটা বহির্বিশ্বে হবে তাতে কি আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে না? আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে না? আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে না? যদি তা-ই পড়ে তাহলে ষড়যন্ত্রটা কার বিরুদ্ধে? এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রটা সম্মিলিতভাবে এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
দলীয়ভাবেও আবার প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কিছু মেকানিজম আছে, সেই মেকানিজম থেকেও উনি মেসেজ পান। বাজারে কী ধরনের দামের ওঠা-নামা চলছে, এটা উনি আমার আগেই মেসেজ পান। তার মেকানিজমটা, তার এক্সপার্টিজটা ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। তার ওই জায়গার অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ, এ কারণে তিনি যখন বিষয়গুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল হন তখন সবগুলো অর্গানের ওই বিষয়টা ক্যারি করতে সমস্যা হয় না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হয় না। এটা হচ্ছে তার সুবিধা।
তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সক্ষমতার এমন জায়গায় পৌঁছেছেন যে চারদিক থেকে মেসেজ নিয়ে এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি কাজগুলো করেন। যেমন- করোনাকালে লকডাউন দেওয়া বা বিভিন্ন ধরনের যাতায়াত বন্ধ করা ইত্যাদি; এসবের মধ্যে দু-একটা ভুল হয়েছে যা তার নলেজের বাইরে হয়েছে কিন্তু উনি…, আমরা অনেকেই অনেক ইমোশনাল কথা বলেছি কিন্তু উনি ইমোশনাল না হয়ে একদম ধীরস্থিরভাবে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন সে সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু আমাদের করোনা মোকাবিলা করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। এটা একটা বড় বিষয়। এ কারণে আমরা উনার অভিজ্ঞতাটা রাষ্ট্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছি। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্থিতি এবং ধীরস্থির। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত থাকায় আমি মনে করি দেশ ভালো চলছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটাকে এককেন্দ্রিকতা বা স্বৈরাচারী মানসিকতা বা নেতিবাচকভাবে যদি চিহ্নিত করি তাহলে এটা তার প্রতি অন্যায় হবে।
তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যেভাবে পরিশ্রম করতে পারেন, এত পরিশ্রম আমরা কেউ বোধহয় করতে পারি না। এটা একটা বড় বিষয় এবং তার অভিজ্ঞতা জাতির স্বার্থে আমরা কাজে লাগাচ্ছি। সবচেয়ে বড় জিনিসটা হচ্ছে, তিনি ঘুমিয়ে দেশ চালান না, তিনি প্রত্যেকটা বিষয়ে কনসার্ন (অবগত) থাকেন, তিনি প্রত্যেকটা বিষয় শোনেন, যেকোনো নোট তার কাছে উপস্থাপন করলে তিনি বানানসহ পড়েন, তার চোখে বানানও আটকায় না। যতগুলো পয়েন্ট থাকে ফাইলের মধ্যে উনি যেটা যেটা প্রয়োজন মনে করেন পড়েন, তারপর মতামত দেন বা অনুমোদন দেন। এ বিষয়ে যা যা করতে হয় তিনি করেন, সেক্ষেত্রে তার সক্ষমতার কাছাকাছি আমরা কেউ-ই নই। এখন এই সক্ষমতাটা অর্জন করা, এটা কিছুটা আল্লাহপ্রদত্ত, আর কিছুটা সাধনা। উনার ওপর আল্লাহর রহমত আছে, সঙ্গে সাধনা। আমি মনে করি সাধনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে কারও চেয়ে এগিয়ে আছেন তিনি।
ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে তারা যখন কিছুই পায় না, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার যখন কিছুই পাচ্ছে না, তখন তারা কিছু ক্রেজি, ইয়াং বাচ্চাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যে বাচ্চাগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করেছে ওদের বয়স কত? ওদের শিক্ষাটা কী? ওদের সামাজিকতা কী? ওদের পরিসরটা কত বড়? এটা গবেষণার বিষয়
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
ঢাকা পোস্ট : অভিযোগ রয়েছে, সরকার পুরোপুরি প্রশাসননির্ভর হয়ে গেছে। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন : আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছি। রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব আমাদের, আওয়ামী লীগের কিন্তু সরকার হিসেবে তো আমরা প্রত্যেকে জনগণের সরকার। এখানে আমাদের প্রত্যেককে সবসময় মাথায় বিষয়টা রাখতে হয় যে জনগণের বিক্ষোভের সঞ্চার হতেই পারে। যেকোনো একজন নাগরিক যেকোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হতেই পারেন। একটা রাজনৈতিক পক্ষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, একটা ধর্মীয় পক্ষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, একটা পেশাদার শ্রেণি সংক্ষুব্ধ হতে পারে। এই সংক্ষুব্ধ হওয়াতে আমরা তাদের দমন করব, এই জায়গাটায় আমরা যাই না। আমরা এমন একটা জায়গায় আসতে চাই, আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক গতিধারা, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে যে জায়গাটা আওয়ামী লীগ করছে, এখানে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাটা একটা বড় বিষয়। কারণ আজ বাংলাদেশে কোনো শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে সেটা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়ার দিনগুলোতে যেটা হয়, ইতিবাচক দিকগুলো কম ছড়ায়, নেতিবাচক দিকগুলো বেশি ছড়ায়। নেতিবাচক দিকগুলো ছড়ানোর ফলে শুধু বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বহির্বিশ্বে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হই।
একটা বিশাল অংশের মানুষ বহির্বিশ্বে চাকরি করেন, তারা আয় করেন, কষ্টে জীবন-যাপন করেন, সেখান থেকে তারা আমাদের দেশে অর্থ পাঠান, সেই অর্থ আমাদের অর্থনীতিতে বড়ধরনের অবদান রাখছে। তারা যদি ওখানে গিয়ে কাজ করে আয় করতে না পারেন সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের কর্মস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচার করেছেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়, টাকার বিনিময়ে নয়, ভালো ভালো খাদ্যগ্রহণের বিনিময়ে নয়। তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে, আরাম-আয়েশ হারাম করে। আমি তার ইসলামকে ধারণ করব, নাকি যারা টাকা ছাড়া বক্তৃতা করেন না তাদের ইসলাম গ্রহণ করব
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
কয়েকদিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। তো এমন নেতিবাচক প্রভাবের কারণে আমাদের মানুষজনকে যদি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমরা তাদের কোথায় রাখব, আমাদের অর্থনৈতিক দিক কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? যারা এখন আমাদের জন্য সম্পদ তারা আমাদের বোঝা হিসেবে পরিণত হবে। রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যেকোনো খারাপ ব্র্যান্ডিং আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সব বিষয় মাথায় রেখে যেকোনো বিক্ষোভ বা সমাবেশ- এগুলোর জন্য যদি আমরা দলকে মাঠে নামাই তাহলে যেটা দাঁড়াবে তা হলো- দুটি রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি সংঘর্ষ। হয়তো দেখা যাবে ওরা আমাদের ১০ জনকে পেটাবে, আবার আমরাও ওদের ১০ জনকে পেটাব। এক্ষেত্রে একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং এটার জন্য মিস ব্র্যান্ডিংটা হবে, সেটা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
এ কারণে মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়েছে, তাদের দাবিগুলো কী, সেটা আমরা অনুধাবনের চেষ্টা করি এবং চেষ্টা করি কীভাবে এটাকে মিট (মোকাবিলা) করা যায়। এই মিট করার চেষ্টাটাও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একটা উচ্ছৃঙ্খল সমাবেশ ভাঙা, এসব জায়গায় যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মী যায় তাহলে তো মারামারি হবে। আর আমরা তো মারামারি আমন্ত্রণ করতে পারি না, কারণ সরকার হিসেবে আমাদের তো দায়িত্বশীল থাকতে হবে। মারামারির আমন্ত্রণটা একধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা।
যার কাজ সে করুক। রাষ্ট্র রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুক। আমরা যখনই এ ধরনের মিছিল-সমাবেশ-বিক্ষোভ, এসব দলীয়ভাবে মোকাবিলা করা শুরু করব তখন আমাদের দলেও মাস্তানতন্ত্রের উত্থান হবে এবং তাদের ওপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। যখন মাস্তানতন্ত্রের ওপর আমরা নির্ভরশীল হব তখন দেখা যাবে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি, আবার সরকারের জন্য তখন এটা চরম বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। সরকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমরা সাংগঠনিক কাজটা আমাদের মতো করে করি, আর এ ধরনের কাজগুলো রাষ্ট্রযন্ত্র তার মতো করে।
করোনার সময় আমাদের যে পরিমাণ নেতাকর্মী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, লকডাউন করা বলেন, গাড়ি আটকানো বলেন, ত্রাণ পৌঁছানো বলেন, স্বাস্থ্যসেবা বলেন— প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী লীগের ইয়াং নেতারা মাঠে ছিলেন; যাদের শক্তি-সামর্থ্য ছিল তারা সবাই মাঠে ছিলেন।
বিএনপি-জামায়াত যখন লাগাতার অবরোধ করে, লাগাতার সবকিছু বন্ধ করে দেয়, তখনও বিএনপি বা জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদনের চাকা বন্ধ হয়নি, পরিবহনের চাকাও বন্ধ হয়নি। তারা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এক্সপোর্ট চালু রেখেছিলেন
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
রাজনীতির মূল কাজটা মানুষের সেবা করা, এই সেবাটা কোন ফর্মে করব? যখন যেভাবে যে চ্যালেঞ্জ আসবে সেভাবে সেবা করতে হবে। মানুষের বাড়িতে যে পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়েছে এবার, এই ত্রাণবিতরণের ক্ষেত্রে যদি সমাবেশ করে বিতরণ করা হতো তাহলে করোনার প্রকোপ আরও বেড়ে যেত। ওই সমাবেশে আগত একজন ব্যক্তি যদি করোনায় আক্রান্ত হতো উনি সবাইকে আক্রান্ত করত। এ কারণে আমরা ত্রাণ বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছি। বাড়িতে পৌঁছানোটা সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে সম্ভব নয়, সরকারি কর্মচারীরা ভলেন্টারি করেছে যাতে চুরি না হয়, কোনো সমস্যা না হয় কিন্তু বাড়িতে পৌঁছানোর কাজটা কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীরা করেছে।
একেকজন কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেম্বারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দলীয় কর্মীরাই সবকিছু করেছে এবং এজন্য তাদের আমরা কোনো পরিবহন ভাড়াও দেইনি, কোনো ভাতাও দেইনি। একদম স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা এগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো আছে বলেই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সংগঠন না থাকলে কখনওই কোনো দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে পারে না, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার জায়গায় আমরা সবসময় খুবই কনসার্ন (সচেতন)।
আমার রাজনৈতিককর্মীকে কোন কাজে ব্যবহার করব, লাঠালাঠিতে ব্যবহার করব নাকি এলাকায় দম্ভের জায়গা সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষকে দমন করতে ব্যবহার করব, নাকি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করব, সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলির ওপর। আমরা সম্মুখ ফাইট করেছি (চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে লগি-বৈঠার আন্দোলন), ওই সম্মুখ ফাইট করতে গিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মাঝখান থেকে এক-এগারোর সৃষ্টি। আমাদের সবসময় মাথায় রাখতে হয় যে, এত ছোট ভূমিতে, এত মানুষের বসবাস, একেকজনের গড়ে ওঠার ধরন একেক রকম, একেকজনের চিন্তা-চেতনা একেক রকম; তাই এখানে প্রতিনিয়তই ক্রাইসিস (সংকট) সৃষ্টি হয় কিছুদিন পরপর। ক্রাইসিসগুলো হট হেডেড (মাথা গরম)-এ মোকাবিলা না করে ধীরস্থিরভাবে মোকাবিলার কৌশলটা অবলম্বন করি আমরা। সে কারণে এখন পর্যন্ত গত ১২ বছরে সরকারের সফলতার ঝুড়ি অনেক বেশি ভারী।
আজ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, এটা কিন্তু নতুন নয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করা, বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করা, বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা— নতুন কিছু নয়। একই পানীয় বারবার নতুন বোতলে ভরছে তারা
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার অবকাঠামোগতভাবে অনেক উন্নয়ন করছে, কিন্তু সেই সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন হয়নি। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন : বাংলাদেশের কিছু মানুষকে আপনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একগুচ্ছ ফুল উপহার দেবেন, তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করবেন, আরাম-আয়েসের ব্যবস্থা করবেন, তারপরও তাকে কখনও খুশি করতে পারবেন না। খুঁত ধরবার চেষ্টা করবে, এটা হচ্ছে কিছু মানুষের প্রবণতা। এই নেতিবাচক প্রবণতা আমাদের দেশে বেশি। আমরা একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে কিছু মানুষ ওই সময়েও দেশটাকে ধারণ করেনি। দেশের বিপক্ষে, মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে। গণহত্যায় সহযোগিতা করে, সাপোর্ট করে। ওই গোষ্ঠীটা এখনও বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারেনি।
সরকারের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ থাকবে, যারা সবসময় নেতিবাচক মন্তব্য করবে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। এখন আমরা কী করছি? আমাদের প্রচারে একটু ভুল হয়েছে। আমরা চোখের সামনে যেটা দেখি সেটা বেশি প্রচারের চেষ্টা করি। সেটা হচ্ছে উন্নয়ন। এত উন্নয়ন তো বাংলাদেশে আগে কখনও হয়নি। অনেক মানুষ স্বপ্নে কখনও দেখেনি যে এত অল্প সময়ে এত কিছু হবে বাংলাদেশে। সেই স্বপ্নগুলো দেখেছেন শুধুমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব— এই স্বপ্নটা আমি নিজেও দেখিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে পদ্মা সেতু নিজের টাকায় হবে। বিলিভ ইট অর নট। একজনই সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন। বাকি সবাই বলেছিল, এটা সম্ভব নয়। এটা সত্য, আমি এটাকে অস্বীকার করব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু হয়েছে। ফলে যে ভালোলাগাটা আমাদের কাজ করছে সেটা হচ্ছে উন্নয়নকেন্দ্রীক প্রচারণা। এখানে আবেগ কিছুটা কাজ করছে। দেশের ভালো, ভালো লাগে। এর বাইরে মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন— এখানেই নেত্রী বড় কাজটা করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত এই বড় অর্জনটা সেভাবে প্রচার হয়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। যখন আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করি সেই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ৬৬ হাজার কোটি টাকা। আর আজ ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। যখন আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করি সেই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ছিল ৬৬ হাজার কোটি টাকা। আজ ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে, মানবের জীবনমান উন্নয়ন খাতে, মানুষের মৌলিক অধিকার দেওয়ার খাতে। এর বাইরে শিক্ষা, চিকিৎসা- প্রত্যেকটা খাতে সরকারের সেবার হাত প্রসারিত হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা আলোচনা রয়েছে, যে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যে দলটি কাজ করছে বলে দাবি করে, তাদের শাসনামলেই দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন : সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতে পারে। এই উপমহাদেশটা ধর্মপরায়ণ মানুষের ভূমি। এই ধর্মপরায়ণ মানুষগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ছাড়াও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। যারা ব্যবহার করে তারা কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আমরা কিন্তু করি না, আমাদের প্রতিপক্ষরা করে।
তারা মানুষকে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে যে আওয়ামী লীগ মানেই ধর্মের বিপক্ষে, ভারতের দালাল। আওয়ামী লীগ দেশবিরোধী, ধর্মবিরোধী ইত্যাদি বলে প্রচারের চেষ্টা করে। তাদের লক্ষ্য একটাই, এই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। একাত্তরে পাকিস্তানিদের পরাজয় তারা মানতে পারেনি, প্রভুদের পরাজয় মানতে পারেনি। ওই প্রভুদের পরাজয় মানতে পারেনি বলেই তাদের টার্গেটটা হচ্ছে যার নেতৃত্বে তাদের প্রভুরা পরাজিত হয়েছে, যে বিশ্বাস, যে চেতনা নিয়ে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীকে হারিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন, তাদের টার্গেট কিন্তু ওই মানুষটি। টার্গেট আসলে বঙ্গবন্ধু, টার্গেট আসলে বাংলাদেশ।
নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব— এই স্বপ্নটা আমি নিজেও দেখিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে পদ্মা সেতু নিজের টাকায় হবে। বিলিভ ইট অর নট। একজনই সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল। বাকি সবাই বলেছিল, এটা সম্ভব নয়
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
আজ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, এটা কিন্তু নতুন নয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করা, বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী-ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা— নতুন কিছু নয়। একই পানীয় বারবার নতুন বোতলে ভরছে তারা। একই বিষয়, বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবেই। সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মতবাদের ভিন্নতা গণতন্ত্রকে পরিশীলিত করে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহযোগিতা করে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে তারা যা শুরু করেছে আমরা কিন্তু ওভার রিঅ্যাক্ট (অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া) করিনি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের ভালোবাসা কমে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। যেহেতু আমরা সরকারের আছি, দায়িত্বশীল জায়গায় আছি, আমরা কিন্তু ওভার রিঅ্যাক্ট করিনি। এটা নিয়ে সারা বাংলাদেশে আমরা যা খুশি তা-ই… তুলকালাম কাণ্ড করিনি। এটা আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মানবিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নে আমরা ধীরস্থিরভাবে এগোতে চাইছি।
মূলত একটা জায়গায় গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সেটা হচ্ছে- দেশটা আমাদের। আমরা দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে দেখব। সেই জায়গাটা কিন্তু তৈরি হয়েছে। যে মানুষটি কট্টর বিএনপি করে বা কট্টর জামায়াত করে, বিএনপি-জামায়াত যখন লাগাতার অবরোধ করে, সবকিছু বন্ধ করে দেয়, তখনও বিএনপি বা জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদনের চাকা বন্ধ হয়নি, পরিবহনের চাকাও বন্ধ হয়নি। তারা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এক্সপোর্ট চালু রেখেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম প্রচার করেছেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়, টাকার বিনিময়ে নয়, ভালো ভালো খাদ্যগ্রহণের বিনিময়ে নয়। তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে, আরাম-আয়েশ হারাম করে। আমি তার ইসলামকে ধারণ করব, নাকি যারা টাকা ছাড়া বক্তৃতা করেন না তাদের ইসলাম গ্রহণ করব?
তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্থিতি এবং ধীরস্থির। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত থাকায় আমি মনে করি দেশ ভালো চলছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটাকে এককেন্দ্রিকতা বা স্বৈরাচারী মানসিকতা বা নেতিবাচকভাবে যদি চিহ্নিত করি তাহলে এটা তার প্রতি অন্যায় হবে
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশে অনেক পরহেজগার মানুষ আছেন। অগণিত পরহেজগার মানুষ আছেন, বুজুর্গ মানুষ আছেন। এই অসংখ্য পরহেজগার মানুষের মধ্যে একটা নাম তো শেখ হাসিনা। তিনি যে কয়দিন আছেন, সে কয়দিন ইসলামসহ প্রত্যেকটি ধর্মের যে পবিত্রতা সেটা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করবেন।
ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে তারা যখন কিছুই পায় না, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার যখন কিছুই পাচ্ছে না, তখন তারা কিছু ক্রেজি, ইয়াং বাচ্চাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যে বাচ্চাগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করেছে ওদের বয়স কত? ওদের শিক্ষাটা কী? ওদের সামাজিকতা কী? ওদের পরিসরটা কত বড়? এটা গবেষণার বিষয়।
তাদের ষড়যন্ত্রটা শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। আজ বাংলাদেশে ভাস্কর্য নিয়ে যদি তুলকালাম কিছু হয়, ফলে যে মিস ব্র্যান্ডিংটা বহির্বিশ্বে হবে তাতে কি আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে না? সেখানে কি আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে না? আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে না? যদি তা-ই পড়ে তাহলে ষড়যন্ত্রটা কার বিরুদ্ধে? এই ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রটা আমাদের সম্মিলিতভাবে এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। (চলবে)
এইউএ/এমএআর