কোন পথে হাঁটবে হেফাজত?
সরকারের নানামুখী চাপে অনেকটা চুপসে গেছে এক সময় রাজনীতিতে উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখা হেফাজতে ইসলাম। সহিংসতার বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার এবং আদালতে হাজিরা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ধর্মভিত্তিক দলটির কার্যক্রম। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চুপসে থাকা হেফাজত আবার যেকোনো সময় সক্রিয় হতে পারে রাজনীতির মাঠে। বিভিন্ন দলের ‘টোপ’ গিলে রাজনীতির মাঠে অনেকটা অপরিপক্ব দল হেফাজত জড়াতে পারে সরকারবিরোধী তৎপরতায়।
যদিও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজত। তবে, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে দলটির নেতারা। আবার সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেও তৎপর তারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার নেতাদের কেউ কেউ এখন পাচ্ছেন জামিন। তাই কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম কোন পথে হাঁটবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়।
>> আলেমদের মুক্তি দিয়ে দেশকে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচান : হেফাজত আমির
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস ঢাকা পোস্টকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এটা দলীয় বিষয় না। ইমানদার সবাই হেফাজতের সমর্থক। আমাদের সঙ্গে কারও বিরোধ নেই। সরকারের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক আছে।
যদিও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজত। তবে, রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে দলটির নেতারা। আবার সরকারের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেও তৎপর তারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার নেতাদের কেউ কেউ এখন পাচ্ছেন জামিন। তাই কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম কোন পথে হাঁটবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতে হেফাজতকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে। তারা ফাঁদে পড়ে সরকারবিরোধী সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। সরকার কৌশলে তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছে। এরপর বাংলাদেশে কওমিভিত্তিক মাদ্রাসাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতা ও হেফাজতের প্রয়াত আমির আহমদ শফীর তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, হেফাজত যেহেতু কর্মীবাহিনী অবস্থায় রয়েছে, সেহেতু তাদের আবারও সহিংস আন্দোলনে জড়াতে অনেকে উসকানি দিতে পারে। সেই ফাঁদে পা না দিতে সরকারকে এবারও কৌশলী হতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে তাদের বুঝাতে হবে। পাশাপাশি হেফাজতের উচিৎ হবে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়টি মাথায় রেখে তারা যেন কোনো সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে না পড়ে।
আরও পড়ুন >> হেফাজত কোনো মুচলেকা দেয়নি : মহাসচিব
এদিকে, বিএনপির নেতাদের কাছে হেফাজতের বর্তমান আমির মুহিব্বুলাহ বাবুনগরীর যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে। আবার যুগপৎ আন্দোলনে সব দলকে পাশে টানতে চাচ্ছে বিএনপি।
অন্যদিকে, হেফাজত যেন বিএনপির সঙ্গে সহিংসতার পথে না বাড়ায় সেজন্য তাদের নজরদারিতে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের আন্দোলন চলমান। যৌক্তিক এ আন্দোলনে যেকোনো দল অংশ নিয়ে পারে।
হেফাজতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদিও তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তারা চাইলে নিজেদের উদ্যোগে যুক্ত হতে পারে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আল্লাহর রাসুল (সা.) কারও ওপর হামলা করেননি। হামলা হলে প্রতিরোধ করেছেন মাত্র। আমি আশা করছি, হেফাজতের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। কারও টোপে তারা কোনো সহিংসতায় জড়াবে না। যদি জড়ায় তবে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’
সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের বিরোধিতা করে ব্যাপক সহিংসতা চালায় হেফাজত। সে সময় সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর দলটির বিষয়ে নড়েচড়ে বসে সরকারের হাইকমান্ড। সিদ্ধান্ত হয় হেফাজতকে কঠোরভাবে দমনের। বিভিন্ন মামলায় তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। একপর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হয় দলটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মামুনুল হককে।
>> ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন চায় হেফাজত
এরপর থেকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সংগঠনটি। হেফাজতের সঙ্গে এক সময় সরকার নানা কৌশলে সমঝোতা করতে চাইতো। এসব ঘটনার পর উল্টো নানা মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় বাধ্য হয় তারা। নানা শর্ত দিয়ে হেফাজতকে ‘নাকে খত’ দেয় সরকার। এরপর সরকারের সঙ্গে হেফাজতের যত বৈঠক হয়, সবগুলোর একমাত্র এজেন্ডা ছিল নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। কওমি ঘরানার শীর্ষ আলেমদের নিয়ে গঠিত ধর্মভিত্তিক দলটি আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। ওই বছর ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয় সংগঠনটি। তাদের ডাকে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
একপর্যায়ে তাদের আন্দোলন অনেকটা সহিংস ও সরকারের বিরোধিতায় রূপ নেয়। ওই বছর ৫ মে হঠাৎ শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় সংগঠনটির লাখো কর্মী। তবে, যৌথ বাহিনীর অভিযানে ওই দিন রাতেই তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই অভিযানে হেফাজতের বেশকিছু নেতাকর্মী হতাহত হন।
এরপর হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফী বেঁচে থাকা পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। এরপর হেফাজতের নেতৃত্বে আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী। তার সময়ে নানা বিষয়ে হেফাজতের সঙ্গে আবার সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যু হয়। এরপর তার মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী নেতৃত্বে আসলেও সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্কের দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
এমআর/এমজে/এমএআর/ওএফ