ঘুরেফিরে ‘শূন্যের বৃত্তে’ চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল
আগামীর বন্দর বলা হচ্ছে বে-টার্মিনালকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রম নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুরু হয় চিঠি চালাচালি। সরকারি জমি অধিগ্রহণ কিংবা বন্দোবস্ত— কোনোটাই শেষ পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। তবে, ২০১৭ সালে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৭ একর জমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাস জমি বরাদ্দ পেতে শুধু চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বাস্তব অগ্রগতি নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় ভূমি বন্দোবস্তের তিনটি ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের কাজেরও তেমন অগ্রগতি নেই। ছয় বছর পর এসে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ‘শূন্যের বৃত্তে’ থেকে গেছে— বলছেন তারা।
খাস জমি বরাদ্দ পেতে শুধু চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বাস্তব অগ্রগতি নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় ভূমি বন্দোবস্তের তিনটি ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের কাজেরও তেমন অগ্রগতি নেই। ছয় বছর পর এসে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ‘শূন্যের বৃত্তে’ থেকে গেছে— বলছেন সংশ্লিষ্টরা
যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, খাস জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করার চেষ্টা চলছে। এটি মূলত জেলা প্রশাসন করে থাকে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজও চলছে। দু-এক মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন >> চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনালের কাজ নির্বাচনের আগেই শুরু হবে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর ৮২০ দশমিক ৫৫৭৫ একর জমি বরাদ্দ পেতে প্রস্তাবনা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন দুটি বন্দোবস্ত মামলা সৃজন করে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। এ সময় বন্দোবস্তের আনুমানিক মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার ২১৮ কোটি ২২ লাখ ৩২ হাজার ৩০১ টাকা। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয় মামলা-মোকদ্দমা এড়াতে খাস জমি অধিগ্রহণের পরামর্শ দেয়। এতে বন্দোবস্ত ফাইল দুটি চট্টগ্রামে ফেরত আসে।
এদিকে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের ১০ জুলাই জেলা প্রশাসন বরাবর ৮০৩ দশমিক ১৭১০ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা দেয়। এর মধ্যে ৮০২ দশমিক ৩৮৩৫ একর খাস এবং শূন্য দশমিক ৭৮৭৫ একর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। জেলা প্রশাসন হয়ে সেই প্রস্তাবনা আবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের চলে আসে। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় ভূমি কমিটির ১২০তম সভায় ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
আরও পড়ুন >> চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
একই বছরের ১৩ নভেম্বর জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণ মামলা সৃজন করে এবং এর মূল্য ধরা হয় তিন হাজার ৫৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৪১ টাকা। তবে, বন্দর কর্তৃপক্ষ ভূমি অধিগ্রহণের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রতীকী মূল্যে জমি বরাদ্দ পেতে আবেদন করে। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রতীকী মূল্যে খাস জমি বরাদ্দ দিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ প্রস্তাব বাতিল করে বন্দোবস্ত প্রস্তাব প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বন্দোবস্ত মামলা দায়ের করে ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে জেলা প্রশাসন। ৭৯১ দশমিক ৭৮৩৫ একর খাস জমির ‘সেলামি মূল্য’ ধরা হয় ১১ হাজার ১০০ কোটি ৮০ লাখ ৬৮ হাজার ২৫১ টাকা। গত বছরের ১৫ নভেম্বর পুনরায় নামমাত্র মূল্যে ভূমি মন্ত্রণালয়কে জমি দিতে অনুরোধ জানায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন >> ৪৬৮ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি : টনক নড়ল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের
সর্বশেষ গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বে-টার্মিনালের জন্য অকৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বন্দরের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বে-টার্মিনালের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার তিনটি নথি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ওই সভায় আলোচনা হয়, বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য অকৃষি খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য তিনটি নথিতে প্রায় ৭৯১ দশমিক ৭৮৩৫ একর জমির প্রস্তাব পাওয়া যায়। এর মধ্যে দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় বিভিন্ন আদালতে মামলাভুক্ত প্রায় ২৫৮ দশমিক ৬৬৩৯ একর জমি রয়েছে। প্রস্তাবিত জমির অন্তর্ভুক্ত মধ্যম হালিশহর ও দক্ষিণ কাট্টলী মৌজার প্রায় ২৬৭ একর জমি সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষিত।
সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান জানান, বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় বন্দর ও জনপদ রক্ষার জন্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ব্যাপ্তির ব্রেক ওয়াটার তৈরি করা হবে। যেটি বনায়নের উদ্দেশ্য পূরণ করবে।
সভায় বে-টার্মিনালের জন্য জমি বন্দোবস্তের তিনটি নথি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে নতুন করে মামলাভুক্ত ও নিষ্কণ্টক জমি আলাদা করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নিষ্কণ্টক জমি বন্দোবস্তের মামলা দায়ের এবং মামলাভুক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত হয়।
যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, খাস জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ করার চেষ্টা চলছে। এটি মূলত জেলা প্রশাসন করে থাকে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজও চলছে। দু-এক মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কয়েকটাতে মামলা রয়েছে। তবে, নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। এজন্য ফাইল তিনটি ফেরত পাঠিয়ে জেলা প্রশাসনকে পুনরায় কয়টিতে মামলা রয়েছে সেটি নির্দিষ্ট করে মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে। সাধারণত জেলা প্রশাসন জমির মূল্য নির্ধারণ করে। টাকা কত দিতে হবে সেটি নির্ধারণ করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
আরও পড়ুন >> বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, জায়গা দিতে পারছি না : নৌ প্রতিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আমরা বন্দোবস্তের প্রস্তাবনা দেই। পরে আবার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় অধিগ্রহণ প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। সবশেষে বলা হলো, বন্দোবস্ত দাও। সেটিও দেওয়া হয়েছে। তবে, শেষের বন্দোবস্ত প্রস্তাবনায় জেলা প্রশাসন কোথায় কোথায় মামলা আছে তা আলাদা করে দেয়নি। পরে সিদ্ধান্ত হয়, যেগুলোর মামলা নেই সেগুলো বন্দোবস্ত এবং যেগুলোতে মামলা আছে সেগুলো অধিগ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো হাত নেই। জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ কিংবা বন্দোবস্তের বিষয়ে বুঝিয়ে দিলে আমাদের কাজ শুরু হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কাজ চলমান। শেষ হলে জানা যাবে।
বে-টার্মিনালের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাস্টার প্ল্যান, ড্রয়িং ডিজাইনের কাজ চলমান। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এটি শেষের দিকে। দু-এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে।
জানা গেছে, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নগরের পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূল ভাগে বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সাগরঘেঁষে বে-টার্মিনাল নির্মাণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্মাণ-সংশ্লিষ্টরা জানান, বে-টার্মিনাল হলে প্রায় ১২ মিটার ড্রাফট (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) এবং যেকোনো দৈর্ঘ্যের জাহাজ সেখানে ভেড়ানো যাবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি বার্থে ভিড়তে পারছে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ।
এছাড়া বে-টার্মিনালে একইসঙ্গে ভিড়তে পারবে ৩৫ থেকে ৫০টি জাহাজ। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দর। তবে, বে-টার্মিনাল পরিচালনায় এ জটিলতা থাকবে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের জট অনেকাংশে কমে যাবে। খরচ কমে গতি আসবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বে-টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯৪ ভাগ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। মূল রপ্তানি বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে হয়। প্রতি বছর জাহাজ, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়তে থাকায় তা সামাল দেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রকল্প হাতে নিতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
এমআর/এমএআর/ওএফ