মাঠে পাঠানোর আগেই বাতিল সাড়ে ১২ লাখ বই
নিম্নমানের কাগজে ছাপানোর কারণে আগামী ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য বিনামূল্যে বিতরণের প্রায় সাড়ে ১২ লাখ বই বাতিল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড(এনসিটিবি)। বাতিল করা এসব বই এখন কেটে ফেলতে হবে অভিযুক্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে।
এছাড়া স্থায়িত্ব (বাস্টিং ফ্যাক্টর), জিএসএম ঠিক না থাকায় নিম্নমানের প্রায় আট হাজার মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করেছে সংস্থাটি।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বইয়ের মান ভালো রাখতে চলতি শিক্ষাবর্ষের দরপত্রে কাগজে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৮০ জিএসএম, মাধ্যমিক স্তরে ৬০ জিএসএম এবং উভয় স্তরে কাগজের স্থায়িত্ব ১৬ থাকা বাধ্যতামূলক করে দরপত্র দেওয়া হয়। এসব নিশ্চিত করতে পারলে বছরের মাঝামাঝি সময়ে বইয়ে ভাঁজ পড়া বা ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
কাগজ ও বইয়ের মান ঠিক রাখতে প্রতি বছরের মতো এবারও প্রাথমিক স্তরে ব্যুরো ভাইডাস এবং মাধ্যমিক স্তরে ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন বিডিকে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠান দুটি ২২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) পর্যন্ত দুই স্তরে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো ১২ লাখ ৩৫ হাজার বই এবং আট হাজার মেট্রিক টন কাগজ বাতিল করেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে বাতিল হয়েছে ১২ লাখ পাঁচ হাজার বই।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরে সাতটি এবং প্রাথমিক স্তরে একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মোট ১২ লাখ ৩৫হাজার ১০৭টি বই বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫ জিএসএম কাগজ দিয়ে মাধ্যমিকের বই ছাপানোয় পাঁচটি বড় প্রিন্টার্সের ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২৪২টি, বাকি বইগুলো বাইন্ডিং ও জাতীয় পতাকার রঙ ঠিক না থাকায় বাতিল করা হয়েছে।
সূত্রমতে, কাগজের মান ঠিক না থাকায় বগুড়ার মা কম্পিউটার প্রিন্টার্সের তিন লাখ ৩৫ হাজার, মানামা প্রিন্টিং প্রেসের দুই লাখ ৮৫ হাজার, অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের এক লাখ ৫০ হাজার, কমলা প্রিন্টিং প্রেসের ৭৮ হাজার, চিস্তি প্রিন্টার্সের দুই লাখ ১৯ হাজার বই বাতিল হয়েছে।
এছাড়া বাইন্ডিং সমস্যার কারণে রাব্বি প্রিন্টিং প্রেসের ৬৭ হাজার, জাতীয় পতাকার রঙের সমস্যার কারণে এসএস প্রিন্টিং প্রেসের ৬৯ হাজার বই বাতিল হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বইয়ের প্রচ্ছদের ভেতরের অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জাতীয় ব্যক্তিত্বদের ছবি, উন্নয়নের স্থিরচিত্র সংযুক্ত এবং মানসম্মত বই দেওয়ার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা রয়েছে। সেজন্য বইয়ের মান ঠিক রাখতে চলতি বছর ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ১৪ থেকে বাড়িয়ে ১৬ করা হয়েছে।
এবার তদারকির ক্ষেত্রেও বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে অন্যান্য বছর পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান কাগজ ও ছাপা হওয়া বই ‘দৈবচয়ন’ পদ্ধতিতে যাচাই করত। কিন্তু এবার পরিদর্শন টিম কাগজের প্রতিটি রোল থেকে স্যাম্পল বই সংগ্রহ করছে। এছাড়া প্রতিটি প্রেসে একজন করে লোক নিয়োগ দেওয়া, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি রাখা, কাগজের জিএসএমের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ প্লাস-মাইনাস যত সম্ভব এড়িয়ে নির্ধারিত মান ঠিক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, আগে তিন স্তরে পরিদর্শন হলেও এবার চারস্তরে তদারকি করছে পরিদর্শন এজেন্সি। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে এবার প্রতিটি প্রেসে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত জুন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম অস্বাভাবিক কমে যায়। ওই সময় ৬০ জিএসএম কাগজের দাম ছিল টন প্রতি ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। সেজন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলন দরের চেয়ে ৩০থেকে ৪৭ শতাংশ কম দামে কাজ নেয়।
জানা গেছে, এনসিটিবি ২০২১ সালের বইয়ের প্রাক্কলন করার সময় কাগজের দাম ছিল ৫৫-৫৮ হাজার টাকা। কিন্তু অক্টোবরে বইয়ের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কাগজের দাম বাড়তে থাকে। ২৩ ডিসেম্বর ৬০ জিএসএম কাগজে রদাম ছিল ৬৫ হাজার ৩০০ টাকা। শুধু তাই নয়, ভালোমানের কাগজও এখন পাওয়া যাচ্ছে না।
এবার কাগজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পেপার মিলগুলো কোনো কারণ ছাড়াই কাগজের দাম বাড়িয়েছে।চুক্তি করেও সময়মতো কাগজ দিচ্ছে না। দিলেও মানসম্মত কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে এনসিটিবির হস্তক্ষেপ চেয়েও আমরা পাইনি।
ব্রাইট প্রিন্টার্সের কর্ণধার মো. মহসিন
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎকাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোই মূল কারণ। অনেক বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ কিনে ইন্সপেকশন এজেন্সিকে চাপ দিয়ে ছাড়পত্র নেওয়ার চেষ্টা করেছে।কিন্তু মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বইয়ের মানে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।এনসিটিবির কঠোর অবস্থানে আট হাজার মেট্রিক টন কাগজ এবং ছাড়পত্র না নিয়ে ছাপানোয় সাড়ে ১২ লাখ বই বাতিল করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান এবং মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবার অস্বাভাবিক দামে কাজ নেয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা প্রাক্কলনের চেয়ে ৩০ থেকে ৪৭ শতাংশ কমে কাজ নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে। কারণ দরপত্রের সময়ের চেয়ে এখন কাগজের দাম টন প্রতি বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এনসিটিবি ও ইন্সপেকশন এজেন্সির কঠোর নজরদারিতে সেটি করতে পারেনি। শুরুর দিকে কিছু প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়েছিল, সেগুলো ধরা পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের দায় ভার মুদ্রণ সমিতির নয়।
এবিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বইয়ের মান ঠিক রাখতে এবার জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে। ইন্সপেকশন এজেন্সিকে কঠোরভাবে কাগজ ও বইয়ের মান ঠিক রাখতে যা যা প্রয়োজন সব করতে বলা হয়েছে। সেজন্য এবার কাগজ ও বই বাতিল তুলনামূলক বেশি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান যত শক্তিশালী হোক না কেন, কাউকে ছাড় না দেওয়ার জন্য মনিটরিং টিম ও এজেন্সিকে বলা হয়েছে।
প্রায় ৩৫ কোটি বই এবার ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ১০ কোটি ২৫ লাখ ৫৩৪ বই এবং মাধ্যমিক স্তরে ২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার বই রয়েছে।
এনএম/জেডএস