সরকারের পাতানো খেলায় জাপা চাইলেই ফল পরিবর্তন করতে পারে না
শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারপ্রধান সংসদ নিয়ন্ত্রণ করেন— এমন দাবি করে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) বলেন, ‘সেখানে (সংসদ) সরকারপ্রধান যেভাবে বলেন সেভাবে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিনি যতটুকু সংশোধন করতে বলেন, ততটুকুই করা হয়। এর বাইরে কিছু করা সম্ভব হয় না। এটা একতরফা পাতানো খেলার মতো। সেই পাতানো খেলায় বিরোধী দল হিসেবে জাপা চাইলেই ফল পরিবর্তন করতে পারে না।’
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জি এম কাদের। জাতীয় পার্টির আগামী দিনের পরিকল্পনা, আওয়ামী লীগ সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা এবং বড় ভাই প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক আদিত্য রিমন।
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এখন সংসদের বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিরোধী দল হিসেবে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছেন বলে মনে করেন?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা মহাজোট গঠন করে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছিলাম। আমাদের প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন আরেকটি জোট ছিল। পরবর্তীতে নির্বাচনের ফলাফলে এমন একটা অবস্থা দাঁড়াল যে প্রতিপক্ষ বিরোধী দলের (বিএনপি) ভূমিকা পালন করতে পারে সেই আসনও পেল না। আমরা আলাদা দল, আলাদা প্রতীকে নির্বাচন করেছি। আমরা তাদের (বিরোধী দল) চেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে (সংসদ সদস্য) নির্বাচিত হয়েছি। প্রশ্ন দাঁড়াল, সংসদ যদি চালু রাখতে হয় তাহলে সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে জনগণ যা বলতে চায়, সরকারের ভুলত্রুটি যেটা ধরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, সেজন্য তো কাউকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন। সিদ্ধান্ত হয়, দায়িত্বটা আমরা (জাপা) গ্রহণ করলে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।
আমরা সংসদে সংখ্যায় বেশি, নিজস্ব রাজনীতি আছে। সেই হিসেবে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে, মোটামুটি সংসদকে কার্যকর করতে তখন আমরা বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই।
আমরা মনে করি, ১৯৯১ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে যে শাসনব্যবস্থা দেশে তৈরি হয়েছে সেটা হলো একনায়কতন্ত্র। সেখানে সত্যিকার অর্থে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নির্যাস, মূল উদ্দেশ্য, সেটা সম্পূর্ণ নিগৃহীত হয়েছে
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
আমরা মনে করি, ১৯৯১ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে যে শাসনব্যবস্থা দেশে তৈরি হয়েছে সেটা হলো একনায়কতন্ত্র। সেখানে সত্যিকার অর্থে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নির্যাস, মূল উদ্দেশ্য, সেটা সম্পূর্ণ নিগৃহীত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সব কার্যক্রম এবং সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সংসদ সেটা অনুমোদন না করবে ততক্ষণ কার্যকর হবে না।
সংসদ হলো দুটি পক্ষ। একটি পক্ষে সরকার, সেখানে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। অপর পক্ষে থাকেন বাকি সবাই (সংসদ সদস্যরা)। এ দুই পক্ষের মধ্যে সংসদে আলাপ-আলোচনা হয়। পরবর্তীতে ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়। সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের বেসরকারি সদস্যও বলা হয়। নিয়মটা আমাদের দেশে আছে, অন্য দেশেও আছে। তারা সরকারি দলের হলেও সরকারের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন। আবার বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরাও সরকারের পক্ষে ভোট দিতে পারেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট পাসের সময় এটা দেখা গেছে। ব্রেক্সিট চুক্তিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সই করার পর যখন সংসদে আসেন, তখন সরকারি দলের অনেক সংসদ সদস্য এর বিরোধিতা করেন। আবার অনেক বিরোধী দলের সদস্যও এটার সমর্থন দেন। চূড়ান্ত ক্ষমতা কিন্তু থাকে সংসদের ওপর। অথচ আমরা সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারি দল বলে একটা জিনিস তৈরি করে ফেলেছি। তারা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না।
সংসদে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারাই সরকারি দল। সরকারি দলের কেউই নিজ দলের বাইরে যেতে পারেন না। গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। ফলে তাকে সবসময় সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকতে হয়।
সরকারপ্রধান যেটা চান, যেভাবে চান, ঠিক সেভাবেই সংসদে সিদ্ধান্ত হয়। কাজেই সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের যে ভূমিকা, সেখানে বিরোধী দলের যে ভূমিকা থাকার কথা, সেটা আমাদের এখানে নেই
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দলীয়প্রধান, সংসদীয় দলের প্রধান, সংসদপ্রধানও। ফলে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেন, সেটাই হয় সরকারি সিদ্ধান্ত, সরকারি দলের সিদ্ধান্ত। তাই যেকোনো সিদ্ধান্তে সরকারি দল জয়ী হয়। সরকারপ্রধান যেটা চান, যেভাবে চান, ঠিক সেভাবেই সংসদে সিদ্ধান্ত হয়। কাজেই সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের যে ভূমিকা, সেখানে বিরোধী দলের যে ভূমিকা থাকার কথা, সেটা আমাদের এখানে নেই। সরকারপ্রধান যেভাবে বলেন, সেভাবে সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিনি যতটুকু সংশোধন করতে বলেন, ততটুকুই করা হয়। এর বাইরে কিছু করা সম্ভব হয় না। ফলে এখানে বিরোধী দলের কিছু করার থাকে না।
এখানে বিরোধী দলের ভূমিকা শুধু এতটুকুই, সরকারের যে কাজ জনগণের পক্ষে নয়, সেটা সংসদে তুলে ধরা। এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করা। সরকার যদি সেটা গ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে তাকে বাধ্য করার মতো কোনো অবস্থা বিরোধী দলের নেই। তারপরও বলা যায়, ১৯৯১ সালের পর থেকে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে যে একনায়কতন্ত্র চলছে, তাতে আগে যারা বিরোধী দলে ছিলেন তারা সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের কার্যক্রমের চেয়ে আমাদের উদ্যোগ ভালো।
আমি মনে করি, এটা যদি কোনোভাবে মূল্যায়নের সুযোগ থাকে তাহলে ১৯৯১-এর পর যে কয়টি সরকার এসেছে তার মধ্যে জাতীয় পার্টি সবচেয়ে বেশি ভালো করেছে। যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন দেখা গেছে, দু-একটি বিষয়ে কথা বলার পর তাদের আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। তখন তারা ওয়াক আউট করেছে, স্থায়ীভাবে সংসদ বর্জন করেছে। ফলে সংসদ মোটেই কার্যকর হয়নি। জনগণের কথা সংসদে বলা হয়নি।
তারপরও জাতীয় পার্টি সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যবহুল বক্তব্য সংসদে এবং সংসদের বাইরে উপস্থাপন করছে
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
আবার যখন বিএনপি বিরোধী দলে আসে, তখন একই কাজ হয়েছে। আমার মনে হয় বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অন্যান্য দলের চেয়ে সফল। কারণ, আমরা চাইলেই সরকার যে ফল ঠিক করে রেখেছে সেটা পরিবর্তন করতে পারব না। পাতানো খেলাই হবে। তারপরও সরকারের দোষত্রুটি তুলে ধরা, সুপারিশ করা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশ গ্রহণ করাও পজিটিভ দিক। এক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে আমরা সফল, এমন দাবি করতেই পারি।
এছাড়া বিরোধী দল (বিএনপি) হিসেবে সংসদের বাইরেও কিছু কাজ থাকে। অনেকে বলেন, সেটা জাতীয় পার্টি করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, একটা সময় ও পরিবেশ ছিল, সেই ধরনের সহনশীলতা ছিল, অনেক আইনও ছিল না; বিরোধী দল অনেক কিছু করার সুযোগ পেত, রাজপথে আন্দোলনও হতো। সেটা করতে গিয়ে অনেক সময় হিংসাত্মক আন্দোলন হয়েছে, হরতাল হয়েছে, গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ২০১৪ সালের পর তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তিন মাসের বেশি সময় দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। তারপরও সরকার পরিবর্তন হয়নি। জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু সরকার পতনের যে আন্দোলন সেটা সফল হয়নি। ফলে, আস্তে আস্তে তারা (বিরোধী দল) আন্দোলন থেকে সরে এসেছে।
এখন মানুষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের বাইরে কিছু পছন্দ করেন না। সবাই এখন নিয়মের মধ্যে থেকে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করার চেষ্টা করেন। এটা শুধু জাতীয় পার্টি নয়, বিএনপিসহ অন্যান্য দলও অবলম্বন করছে। তারপরও জাতীয় পার্টি সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যবহুল বক্তব্য সংসদে এবং সংসদের বাইরে উপস্থাপন করছে।
ঢাকা পোস্ট : অনেকে জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলেও হাসিঠাট্টা করেন। আপনার কাছে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী মনে হয়?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : যারা হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করেন, আমার মনে হয় তারা এটা বুঝে করেন না। জাতীয় পার্টির সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন বৈধ সরকার এরশাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনিও (এরশাদ) সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সেই সরকার সম্পূর্ণ বৈধ ছিল।
যারা হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করেন, আমার মনে হয় তারা এটা বুঝে করেন না। জাতীয় পার্টির সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন বৈধ সরকার এরশাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনিও (এরশাদ) সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সেই সরকার সম্পূর্ণ বৈধ ছিল
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
হাইকোর্টে সপ্তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল, ওই অংশটুকু নিয়ে তখন তারা কোনো মন্তব্য করেননি। কাজেই একটি বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করেছিল। একটি বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সরকার পতন আন্দোলন কতটুকু বৈধ, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তারপরও তিনজোটের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বাম দলগুলো) কথা মতো, তাদের অঙ্গীকারের ওপর বিশ্বাস রেখে তিনি (এরশাদ) সম্পূর্ণ সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কথা ছিল, সবাই ক্ষমতার বাইরে এসে নির্বাচন করবে এবং যে জয়ী হবে সেই সরকার গঠন করবে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে শুধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে জেলে নেওয়া হয়নি, সব সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, যদিও তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের গ্রেফতার করা হয়। জাতীয় পার্টির অফিস ও কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশ ও প্রশাসনকে দিয়ে জাপার সভায় হামলা করা হয়। এমনকি নির্বাচনে এরশাদকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
সর্বশেষ ধারণা করা হয়েছিল, জাতীয় পার্টি মানেই এরশাদ, এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি। তিনি যখন মারা যাবেন, তখন জাতীয় পার্টি থাকবে না। জাতীয় পার্টিকে ভাগ করার জন্য নানা ধরনের কৌশল নেওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেটা সম্ভব হয়নি। কেউ প্রমাণ করতে পারেননি এরশাদ জনগণের কাছে নিন্দিত ছিলেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। যখন যেখানে ছিলেন, জেলখানায়, হাসপাতালে; নির্বাচনে এজেন্ট দিতে পারেননি, মিটিং-মিছিল করতে পারেননি, তারপরও তিনি পরাজিত হননি।
কেউ প্রমাণ করতে পারেননি এরশাদ জনগণের কাছে নিন্দিত ছিলেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। যখন যেখানে ছিলেন, জেলখানায়, হাসপাতালে; নির্বাচনে এজেন্ট দিতে পারেননি, মিটিং-মিছিল করতে পারেননি, তারপরও তিনি পরাজিত হননি
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সম্ভব হয়নি। রাজনীতিতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি যখন মারা যান, তখনও বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। তার প্রতি মানুষের কী পরিমাণ সহানুভূতি ছিল, মারা যাওয়ার আগেও প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য। মৃত্যুর পর তার জানাজায় যে গণজমায়েত হয়েছিল কোনো পাবলিক মিটিংয়েও সেটি হয় না।
এরশাদ ওষুধনীতি করেছেন, স্বাস্থ্যনীতিও করেছিলেন। যেটা বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হয়নি। এখনও অনেক ডাক্তার আমাকে বলেন, স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন হলে এখন এ খাতের যে দুরবস্থা, তা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব ছিল।
আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে আবারও জাতীয় পার্টির পুনরুত্থান হবে। এই যে দুটি দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি), মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাদের কাছ থেকে মানুষ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, তারা চাচ্ছেন উদ্ধার পেতে। কিন্তু একনায়কতন্ত্র থেকে উদ্ধার হতে পারছেন না। কারণ, দেশে সুশাসনের অভাব। দেশে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষে-মানুষে বৈষম্য। পশ্চিম আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের কারণেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ওই সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী হাজার-হাজার কোটি টাকার মালিক ছিলেন, অধিকাংশ মানুষ ছিলেন গরিব। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন। এখন সেই বৈষম্য আবার আমরা দেখছি। আগের তুলনায় আরও বেশি। এগুলো থেকে আমরা রক্ষা পেতে চাই।
১৯৯১ সালের পর থেকে নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। যেটা সামনের দিনে একমাত্র জাতীয় পার্টিই পূরণ করতে পারবে
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
১৯৯১ সালের পর থেকে নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। যেটা সামনের দিনে একমাত্র জাতীয় পার্টিই পূরণ করতে পারবে।
ঢাকা পোস্ট : আন্দোলনের মুখেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করেছেন। এখন আপনি বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে আর সরকার পতন সম্ভব নয়। কেন এমন মনে হচ্ছে?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : প্রথম কথা হলো, আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সাহেব ক্ষমতা ছেড়েছেন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি তাদের বিশ্বাস করেছিলেন এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন যে, ক্ষমতার বাইরে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন এবং জনগণ তাকে ভোট দেবেন। তার দল আবার ক্ষমতায় আসবে। এ বিশ্বাস থেকে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। গুটিকয়েক মানুষের ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। আন্দোলনের মাধ্যমে তার পতন হয়েছিল, এটা আমি বিশ্বাস করি না।
আমি রাজনীতি করি। আমাকে অনেকে ভালো বলবেন, আবার খারাপও বলবেন। কে কী বললেন, তা নিয়ে আমি এতটুকু বিচলিত নই। যদি কেউ কিছু বলেন, আমি সেটা যাচাই করে দেখি। ভুলত্রুটি থাকলে সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করি
গোলাম মোহাম্মদ কাদের, চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
আর আন্দোলনের মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে সরকার পতন সম্ভব কি না, সেটা দেখার বিষয়। কারণ, আন্দোলনের বিপক্ষে যে ধরনের আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, তাতে স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের যে ধারা একসময় আমাদের দেশে ছিল বা অন্যান্য দেশে আছে, সেটা বর্তমানে আমাদের দেশে আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকা পোস্ট : হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর আগে থেকেই পার্টির চেয়ারম্যান হওয়া নিয়ে আপনার আর রওশন এরশাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এখন আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : আমাদের সম্পর্ক ভালো। কোনো সময়ই খারাপ ছিল না। পাশাপাশি বসবাস করতে গেলে মতের বিরোধ থাকবে না, সবসময় সহমত থাকবে— এটা স্বাভাবিক নয়। আবার সবসময় সংঘাত হতে থাকবে— এটাও স্বাভাবিক নয়। আমাদের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই। আমরা একসঙ্গে আছি এবং দলও ঐক্যবদ্ধ। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জাপা। আমি মনে করি, দল সামনের দিকে অগ্রসরমান। কোনো দ্বিধা-বিভক্তি নেই। মতবিরোধ থাকতে পারে, এটা সব দলেই থাকে। কিন্তু সেটার জন্য দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
ঢাকা পোস্ট : এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক মাঝেমধ্যে অভিযোগ করেন, আপনি গঠনতন্ত্র বহির্ভূত চেয়ারম্যান। এছাড়া নানা কথা বলেন তিনি। তার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমি রাজনীতি করি। আমাকে অনেকে ভালো বলবেন, আবার খারাপও বলবেন। কে কী বললেন, তা নিয়ে আমি এতটুকু বিচলিত নই। যদি কেউ কিছু বলেন, আমি সেটা যাচাই করে দেখি। ভুলত্রুটি থাকলে সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করি।
এএইচআর/এমএআর/