নতুন বইয়ের গন্ধে মাতবে সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী
করোনার মধ্যেও আগামী ১ জানুয়ারি (শুক্রবার) শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ের দুই মাস দেরিতে শুরু করেও বই ছাপার কাজ প্রায় শেষ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিকের ৯৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৮৫ শতাংশ বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে।
এনসিটিবি ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষার সব ধরনের কার্যক্রম। এরই মধ্যে আগামী ১ জানুয়ারি প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
আগামী ৩১ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে বই বিতরণের আনুষ্ঠানিকতার উদ্বোধন করবেন। পরের দিন অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিন সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বই বিতরণ করা হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার সারাদেশে বই উৎসব হবে না। তবে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ী, দাখিল, ভোকেশনাল স্তরে সর্বমোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আলাদাভাবে আরও প্রায় আড়াই লাখ বই বিতরণ করা হয়।
এনসিটিবির বিতরণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট চার কোটি ৪৩ লাখ তিন হাজার শিক্ষার্থীর হাতে প্রায় ৩৫ কোটি বই তুলে দেওয়া হয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য কাছাকাছি সংখ্যা ধরে বই ছাপানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১ জানুয়ারির আগেই প্রাথমিক পর্যায়ের ৯৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৮৫ শতাংশ বই উপজেলায় পৌঁছে যাবে। কিছু বই বাকি থাকবে, সেগুলো বই উৎসবের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। কারণ বাকি বইগুলোর মধ্যে ৫ শতাংশ বাফার স্টকের বই। এগুলো পরে গেলেও সমস্যা হবে না।
তিনি আরও বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ দায়িত্বে আমাদের সহযোগিতা করেছে। সময়ের আগেই বই ছাপিয়ে উপজেলায় পাঠিয়েছে। করোনাসহ বিভিন্ন জটিলতায় একটু দেরিতে কাজ শুরু হলেও ডিসেম্বরের মধ্যে সিংহভাগ বই বিভিন্ন উপজেলায় পৌঁছে যাবে।
এদিকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ছাপা বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা। নিম্নমানের কাগজে ছাপানোর কারণে বিনামূল্যে বিতরণের প্রায় সাড়ে ১২ লাখ বই বাতিল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
প্রাথমিকের ১০ কোটি বই প্রস্তুত
চলতি বছর প্রাথমিকে ১০ কোটি ২৫ লাখ পাঁচ হাজার ৩৪ কপি বই ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। মোট ৯৮টি দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বই ছাপানোর কাজ পায়। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা জরিমানা ছাড়াই বই সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু সরকার নতুন বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে চায়। তাই এনসিটিবি মুদ্রণকারীদের ডিসেম্বরের মধ্যেই বই সরবরাহের অনুরোধ জানায়।
এনসিটিবির বিতরণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯৫ শতাংশ বই ছাপিয়ে উপজেলায় পৌঁছে দিয়েছে। ছোট কিছু প্রিন্টার্সের কিছু বই বাকি রয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে তারা কাজ শেষ করবে।
২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে নয় কোটি ৯৪ লাখ বই ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। ছাপানোর বইগুলো ইন্সপেকশন এজেন্সির ছাড়পত্র নিয়ে উপজেলায় পাঠাতে হয়। এ কাজ করতে অন্যান্য বছর এক সপ্তাহ লাগলেও এবার তা একদিনেই পিডিআই (প্রি-ইন্সপেকশন অব ডেলিভারি) দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে পিডিআই পেয়েছে আট কোটি ৫৫ লাখ বই। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি বইগুলোর পিডিআই পাওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
মাধ্যমিকে প্রস্তুত ১৮ কোটি বই
২০২১ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরে ২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার কপি বই ছাপানো হবে। এর মধ্যে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ কোটি ১৩ লাখ বই ছাপানো হয়েছে। পিডিআই পেয়েছে ১৬ কোটি ৫৫ লাখ বই। বাকি বইগুলো ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে দেওয়ার কাজ শেষ হবে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ কাগজের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তাতে আরও চার কোটি বই ছাপানো সম্ভব হবে। তবে বইগুলোর ছাপা শেষ হয়ে উপজেলায় পৌঁছাতে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ লেগে যাবে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি বই পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে ৫ শতাংশ বই বাফার স্টকে থাকে। বইগুলো দুর্যোগ সময়ের জন্য রাখা হয়। এগুলো একটু দেরিতে পাঠানো হবে।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার মতো পরিস্থিতিতে বই ছাপানোর কাজ ভালোভাবেই প্রায় শেষ হয়েছে। চলতি বছর কাগজের মান ঠিক রাখতে বাস্টিং ফ্যাক্টর (বিএফ) ১৪ থেকে ১৬ করায় নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো সম্ভব হয়নি। এতে একটু সমস্যা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে বইয়ের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ কালার করে ছাপানো হচ্ছে। সেজন্য বেশকিছু ছবি বাছাই করে পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে সময় লেগেছে। এতে মাধ্যমিকে বই ছাপাতে কিছুটা দেরি হয়েছে। এরপরও বেশিরভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সময়ের আগেই বই ছাপানোর কাজ শেষ করেছে।
এ ব্যাপারে দুলাল প্রিন্টিং প্রেসের মালিক দুলাল সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী আগামী বছরের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বই দিতে পারব। কিন্তু তার আগেই আমার প্রায় ৯০ শতাংশ বই ছাপানোর কাজ শেষ করেছি।
নতুন বই পাওয়া প্রসঙ্গে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে নতুন বছরের বই শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও রোল অনুযায়ী প্যাকেট করে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বই বিতরণ করা হবে।
গত ৬ অক্টোবর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যাদেশপত্র দেওয়া হয়। বই ছাপার জন্য প্রাথমিকে নিয়মিত ৯৮ দিন এবং মাধ্যমিকে ৬০ দিন সময় পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই বই ছাপানো হবে বলে আশ্বস্ত করে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, সক্ষমতা অনুযায়ী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করেছে। এজন্য শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সময়মতো বই পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বই উৎসব না হলেও বছরের প্রথম দিন যাতে শিক্ষার্থীরা বই পায় এবং তাদের উৎসাহে যাতে কোনো ঘাটতি না থাকে, সে চেষ্টাই করা হচ্ছে।
বইয়ের মান ঠিক রাখতে চার স্তরের মনিটরিং
এবার বইয়ের মান ঠিক রাখতে চার স্তরে তদারকি কার্যক্রম চলছে। প্রথম স্তরে কাগজের মান দেখা হচ্ছে। পরিদর্শন এজেন্সি প্রেস থেকে কাগজের তিন কপি নমুনা সংগ্রহ করে এক কপি প্রিন্টার্স, এক কপি এনসিটিবি এবং অন্য কপি ল্যাবে পরীক্ষা করছে। কাগজের মান ভালো হলে ছাড়পত্র, না হলে তা বাতিল করে প্রেস থেকে সেই কাগজ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। কাগজের ছাড়পত্রের পর বইছাপা পর্যন্ত প্রতিটি রুল তদারকি করতে একজন কর্মকর্তা ২৪ ঘণ্টা ওই প্রেসে অবস্থান করছেন।
ছাপার পর প্রি-ইন্সপেকশন ডেলিভারি (পিডিআই) করা হচ্ছে। সেখানে ছাপা বই সঠিক আছে কি-না, তা যাচাই করা হচ্ছে। সেখানে ছাড়পত্র পাওয়ার পর উপজেলায় পাঠানোর ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, বই উপজেলায় পৌঁছানোর পর সেখান থেকে নমুনা বই সংগ্রহ করা হবে এবং আগের বইয়ের সঙ্গে মান মেলানো হবে।
এভাবে কঠোর তদারকির মধ্যে পাঠ্যবইয়ের মান যাচাই করা হচ্ছে। এসব স্তরে আগে বিভিন্ন কারসাজি হতো। পরিদর্শন টিম ও মুদ্রণকারীদের যৌথ কারসাজিতে নিম্নমানের বই ছাপানো হতো এবং তা সরবরাহ করা হতো। এবার কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে তা বন্ধ হয়েছে।
এনএম/জেডএস/এমএআর