ঢাবিতে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ আছে আর মাত্র এক মাস। নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষের আগে সিনেটের বিশেষ অধিবেশনে সদস্যদের ভোটে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয় কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে এখনও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ কারণে ক্ষোভ বিরাজ করছে ঢাবির সিনেট সদস্যদের মধ্যে। এভাবে নির্বাচন দিতে গড়িমসি করলে আওয়ামী সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকদের অসন্তোষ বাড়বে বলে মতামত সংশ্লিষ্টদের।
তবে, টানা তৃতীয় মেয়াদে একজন উপাচার্য নিয়োগের নজির না থাকায় পরবর্তী উপাচার্য কে হচ্ছেন তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ এ পদে বসতে ইতোমধ্যে নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগপন্থি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। সিনেট সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা-তদবির করছেন কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-এর আদেশ অনুযায়ী, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিতে অন্তত ১৩ কার্যদিবস আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। সিনেটের ১০৫ সদস্যের ভোটে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত হবে। সিনেটে ভোটাভুটিতে প্যানেল চূড়ান্ত হওয়ার পর সেই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তিনি চাইলে প্যানেলের বাইরে থেকেও উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেন।
অপরদিকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দিতে ঢাবিতে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৬ অক্টোবর। এর ছয় দিন পর ২ নভেম্বর শেষ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের দ্বিতীয় মেয়াদ। যেহেতু ১৩ কার্যদিবস আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হয় তাই নির্বাচন দিতে হলে চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু আপাতত নির্বাচন নিয়ে না ভেবে বিশেষ সমাবর্তন নিয়ে উপাচার্যকে বেশি চিন্তিত বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ কারণে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয় কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
আরও পড়ুন
এছাড়া, একই পদে তৃতীয়বার দায়িত্বে আসার নজির না থাকার পরও এ পদে থাকতে সমাবর্তনকে বর্তমান উপাচার্যের ‘সরকারকে খুশি করার কৌশল’ হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক সমাজ। ২০১৯ সালে ঢাবির এ বিশেষ সমাবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন বর্তমান উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ। সেই সমাবর্তন কালক্ষেপণ করতে করতে পিছিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে নিয়েছেন বর্তমান উপাচার্য। তিনি আবারও উপাচার্য পদে থাকতে চান। সে কারণেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে বিশেষ সমাবর্তনের তারিখ নির্ধারণ করেছেন বলে মনে করেন কেউ কেউ। অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এ পদে থাকতে তিনি সরকারের উচ্চ মহলে যোগাযোগ ও তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি সিনেট অধিবেশন ও প্যানেল নির্বাচন আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাবির সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের একটি অংশ। এরপর বেশকিছু দিন পেরিয়ে গেলেও উপাচার্য বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেননি।
সম্ভাব্য তালিকায় বেশকিছু নাম ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা হলেন- ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া, ঢাবি নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জিয়া রহমান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম প্রমুখ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের লক্ষ্যে ঢাবির সর্বশেষ সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই। ওই সময়ে বিএনপি-জামাত সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের অধিবেশন বর্জন এবং অন্য কোনো শিক্ষকের প্যানেল না থাকায় ওই সময় অধিবেশনে কোনো ভোটাভুটি হয়নি। আওয়ামীপন্থি তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এর আগে ৩০ জুলাই নীল দলের শিক্ষক প্রতিনিধি ও গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিরা উপাচার্য প্যানেল মনোনয়নে নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটিতে যান। সেখানে সর্বোচ্চ ৪২ ভোট পেয়ে ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ প্রথম, ৩৬ ভোট পেয়ে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্বিতীয় এবং ৩০ ভোট পেয়ে অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
তবে, অভ্যন্তরীণ ভোটে পিছিয়ে থাকলেও নিজের ক্ষমতাবলে সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য আখতারুজ্জামান নিজেকে এক নম্বর ঘোষণা করে প্যানেল দেন। নীল দলের পক্ষে মনোনীত প্যানেল প্রস্তাব করেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। এরপর রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এস এম বাহালুল মজনুন চুন্নু সেই প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
এ নিয়ে অধিবেশনে শিক্ষকরা প্রশ্ন তুললেও উপাচার্য কোনো জবাব না দিয়ে প্যানেল ঘোষণা করেন এবং জাতীয় সংগীত বাজিয়ে অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা করেন যা ছিল রীতিবিরোধী ও জাতীয় সংগীতের অপব্যবহার। কারণ, সিনেট অধিবেশনে দ্বিতীয়বার জাতীয় সংগীত বাজানো আইন ও রীতি পরিপন্থি।
আরও পড়ুন
ন্যক্কারজনক ওই ঘটনা সে সময়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে, এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নিয়মের তোয়াক্কা না করে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ এলাকার লোকদের প্রাধান্য ও আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে উপাচার্যের জনপ্রিয়তা শিক্ষক সমাজ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের কাছে একেবারে শূন্যের কোঠায়। এ কারণে তিনি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিতে কালক্ষেপণ করছেন।
এ বিষয়ে একজন সিনেট সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। এ বিষয়ে এখনও কাউকে কিছু বলতেও শুনিনি। সুতরাং সঠিক সময়ে প্যানেল নির্বাচন হবে কি না, সেটি শুধু আমি না, কেউ-ই বলতে পারবে বলে মনে হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঢাবি-শিক্ষক ও সিনেট সদস্য বলেন, বর্তমানে জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ, সাদা দল এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দুর্বল। সিনেটে তাদের সদস্য সংখ্যা ১০৫ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন। কাজেই গণতান্ত্রিক উপায়ে সিনেটে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করাটা সব পক্ষের জন্য সম্মানজনক হবে এবং তিয়াত্তরের আদেশ সমুন্নত থাকবে।
আরও পড়ুন
তবে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে না ভেবে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন সাদা দলের শিক্ষকরা। সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন কবে হবে সেটি ঢাবি উপাচার্যের ওপর নির্ভর করে। তিনি বিশেষ অধিবেশন ডাকবেন এবং প্যানেল নির্বাচন ঘোষণা করবেন। আমরা এখন পর্যন্ত উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুনিনি। নিজেরাও এ বিষয়ে বৈঠকে বসিনি। আমরা অংশগ্রহণ করব, না কি সরে দাঁড়াব, সেটি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তবে, বর্তমানে আমরা বিএনপির এক দফা আন্দোলনের দিকে বেশি মনোনিবেশ করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-এর আদেশ অনুযায়ী, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিতে অন্তত ১৩ কার্যদিবস আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। সিনেটের ১০৫ সদস্যের ভোটে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল চূড়ান্ত হবে। সিনেটে ভোটাভুটিতে প্যানেল চূড়ান্ত হওয়ার পর সেই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তিনি চাইলে প্যানেলের বাইরে থেকেও উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেন
এদিকে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য পদে নিয়োগের নজির না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ শীর্ষ পদে বসতে ইতোমধ্যে নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। সম্ভাব্য তালিকায় বেশকিছু নাম ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা হলেন- ঢাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া, ঢাবি নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. জিয়া রহমান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম প্রমুখ।
উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য বিশেষ অধিবেশনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে এখন বলার কিছু নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। সময় হলে সবাই সেটি জানতে পারবে।
কেএইচ/এমএআর