দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধের পাশাপাশি তৃতীয়টির জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে
প্রথম ওয়েব কমে যাওয়ার পরও যদি আমরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতাম, আমাদের প্রশাসন যদি ওরকম শক্ত অবস্থানে থাকত, তাহলে কিন্তু সেকেন্ড ওয়েবটা আসত না এবং নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টও আমাদের শরীরে ঢুকত না। ফলে তারা বাইরে থেকে ধরন পাল্টাতে না পেরে একসময় দুর্বল হয়ে যেত। কিন্তু আমরা যখন দ্বিতীয় ওয়েবের জন্য প্রস্তুত থাকলাম না, স্বাস্থ্যবিধি মানলাম না; এ সুযোগে ভাইরাসটা ঠিকই মানুষের মধ্যে ঢুকে গেল। দেশে তৃতীয় ওয়েবও যদি আসে, এভাবেই আসবে। সেজন্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ঢেউ প্রতিরোধের জন্যও আমাদের কঠোরভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে...
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। হাসপাতালগুলোতে শ্বাসকষ্টসহ করোনার নানা উপসর্গ নিয়ে নতুন রোগীর ভিড় বাড়ছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন সন্দেহভাজন কিংবা কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিরা। তবুও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সিট বা আইসিইউ বেড। দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি, দ্বিতীয় ঢেউ, নতুন ভ্যারিয়েন্টসহ নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু। কথা বলেন সংক্রমণ রোধে ব্যক্তি ও সরকারের নানা করণীয় প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : দেশে আশঙ্কাজনকভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বলছে, বাজার-গণপরিবহন থেকে মানুষ বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন। এদিকে, দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : রোগীর সংখ্যা এখন প্রচুর। আমাদের প্রতিদিন প্রচুর স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে কিছুটা কমে গিয়েছিল। ওই সময় প্রতিদিন মেশিন রান হতো একবার, এখন রান করতে হয় তিনবার। একবার রান করার সময় ৯৬টি স্যাম্পল দেওয়া হয় মেশিনে। রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও মানুষ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এখন অসুস্থের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। যাদের শরীরে ইমিউন পাওয়ার (প্রতিরোধ ক্ষমতা) বেশি তারা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। যারা অসুস্থ তারা হয়ত মারা যাবেন। আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, জনসমাগম বন্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়া, বিদেশ থেকে যারা এসেছেন সঠিকভাবে তাদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি কারণে করোনার বর্তমান পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। আমরা ভেবেছিলাম, করোনাকে জয় করে ফেলেছি। এখন এটি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। কিন্তু ভাইরাসটি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সেটাই দেখার বিষয়। কারণ, ইতোমধ্যে এটি যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তার একটি খারাপ প্রভাব আমাদের ওপর আসবেই।
দেখা যাচ্ছে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ৭০ থেকে ৯০ ভাগ বেশি আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে, দ্রুত ছড়ায়। আগে যেমন নাকের ভেতরে গিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করত, তারপর ফুসফুসে যেত; সেটার আর দরকার পড়ে না। তারা এখন সরাসরি ফুসফুসে চলে যায়। ফুসফুসকে সংক্রমিত করে। অর্থাৎ আগে ভাইরাসটি নাকে থাকলে সর্দি, কাশি ও জ্বর হতো; এখন সেগুলো হচ্ছে না। সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের সামান্য মাথাব্যথা, গাব্যথা; পরে সিটি স্ক্যানে দেখা যায় যে তার ফুসফুস ৩০ থেকে ৫০ ভাগ অকার্যকর হয়ে গেছে। ওইদিকে করোনা পরীক্ষাতেও পজিটিভ না এসে বারবার নেগেটিভ আসছে
মনে করেন দেশে একটা মহামারি আসল। যদি নতুন ভাইরাস হয় (নোবেল ভাইরাস), যার বিপরীতে আগে থেকে মানুষের শরীরে কোনো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না, মানুষ দ্রুত আক্রান্ত হবেন। যদি ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়াবে। একটি দেশ থেকে যখন ভাইরাসটি আরেকটি দেশের সীমানা ছাড়ায়, তখনই এটি মহামারিতে রূপ নেয়।
মহামারির অনেকগুলো স্টেজ আছে। এটা যখন মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াতে থাকে, তখন বুঝতে হবে ভাইরাসটি মহামারির তৃতীয়/চতুর্থ স্তরে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় এটি খুবই মারাত্মক রূপ নেয়। ভাইরাসটির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এতটাই কঠোর থেকে কঠোরতর হতে হবে, যাতে এটা পরবর্তীতে আর সংক্রমিত হতে না পারে অর্থাৎ পঞ্চম/ষষ্ঠ স্তরে যেতে না পারে।
আমাদের একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, প্রতিটি মহামারি কিন্তু এক থেকে দুই বছর স্থায়ী হয়। এমনকি এর চেয়েও বেশি সময় থাকতে পারে, যদি আপনার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঠিক মতো না হয়। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু দুই বছর ছিল। ২০০৯ সালের বার্ড ফ্লু/সোয়াইন ফ্লু দুই বছরের অধিক সময় ছিল। সুতরাং কোনো দেশে যখন একটা মহামারি চলবে, তখন প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে কঠোর প্রস্তুতি নিতে হবে। যাতে পরবর্তীতে আরেকটা ওয়েব (ঢেউ) না আসে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ওয়েবে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্টেজ পরে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে সংক্রমণ কমে গেছে। ওই সময় আমাদের জনসাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানা ছেড়ে দিয়েছিল, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমিয়েছিল, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ শুরু হয়েছিল। যে কারণে আবার দ্বিতীয় ঢেউ এসে হানা দিল। আমাদের দায়িত্বশীলরাও ভুলে গিয়েছিলেন যে যখন একটা মহামারি চলে সেটা দুই থেকে তিন বছর স্থায়ী হয়। সেই সময় আমাদের যেমন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, ঠিক তেমনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও সেকেন্ড ওয়েব বা থার্ড ওয়েব যেন না আসে সে লক্ষ্যে কঠোরভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সংক্রমণ কিছুটা কমার পর আমরা সেটা করলাম না। না করে সাধারণ মানুষকেও স্বাস্থ্যবিধি ছেড়ে দিতে সুযোগ করে দিলাম। ফলে নতুন করে আজ রেকর্ড সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুরও রেকর্ড হচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : সেকেন্ড ওয়েব বা থার্ড ওয়েব কখন আসতে পারে, আমরা কীভাবে বুঝব?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : একটা মহামারি অনেকদিন ধরে চলতে থাকলে ভাইরাসের আগের ভ্যারিয়েন্টটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তন, মানুষের মধ্যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি, টিকার ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি— এসব কারণে ভাইরাসটা একটা প্রেশারের মধ্যে থাকে। ফলে ওইসময় সে পরিবর্তিত হতে থাকে। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে সে যেন তার বংশ বৃদ্ধি করে টিকে যেতে পারে সেজন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে থাকে। আমরা এটাকে বলি মিউটেশন (পরিবর্তন)। সেই পরিবর্তনটাও কিন্তু মানুষের শরীরে ঢুকেই হয়। বাইরে সে তার ধরন পরিবর্তন করতে পারে না। ওই মানুষটা যেখানেই যাবে, যে দেশেই ঘুরবে, সেখানেই নতুন ধরনটিও ছড়িয়ে যাবে।
সুতরাং একটা জিনিস বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে যে আরেকটা ওয়েব যখন আসবে তখন নতুন ভ্যারিয়েন্টের দরকার হবে। যার বিপরীতে আমাদের আগে থেকে কোনো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে না। যেমন ধরেন, করোনার আগের যে ভ্যারিয়েন্টটা ছিল, সেটা কমে গেছে বলেই ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট, ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যারিয়েন্টসহ বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে। এসব ভ্যারিয়েন্ট যে আমাদের দেশে হয়নি, সেটা তো বলা যাবে না। কারণ আমাদের দেশে ওরকম কোনো প্রমাণ নেই, গবেষণাও নেই। সেজন্য আমরা বলতে পারি না, আছে কি নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন যেহেতু আমাদের দেশে আসা-যাওয়া করছে, প্রতিটি ভ্যারিয়েন্ট অবশ্যই আমাদের দেশেও এসেছে, কিন্তু আমরা সেটা বের করতে পারছি না। কারণ আমাদের সেরকম গবেষণা নেই।
প্রথম ওয়েব কমে যাওয়ার পরও যদি আমরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতাম, আমাদের প্রশাসন যদি ওরকম শক্ত অবস্থানে থাকত, তাহলে কিন্তু সেকেন্ড ওয়েবটা আসত না এবং নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টও আমাদের শরীরে ঢুকত না। ফলে তারা বাইরে থেকে ধরন পাল্টাতে না পেরে একসময় দুর্বল হয়ে যেত। তখন তাদের কিছু এমনিতেই মারা যেত এবং কিছু এত দুর্বল হয়ে যেত যে তারা কমন কোল্ড ডিজিজ (হাঁচি, কাশি, সর্দি) ছাড়া আর কোনো জটিল ইনফেকশন (সংক্রমণ) তৈরি করতে পারত না।
কিন্তু আমরা যখন দ্বিতীয় ওয়েবের জন্য প্রস্তুত থাকলাম না, স্বাস্থ্যবিধি মানলাম না; এ সুযোগে ভাইরাসটা ঠিকই মানুষের মধ্যে ঢুকে গেল। ঢুকে সে নিজের বংশবিস্তার করতে থাকল এবং মিউটেশন হয়ে দ্রুত ধরন পাল্টে নতুন ধরন বের করল। ফলে সেকেন্ড ওয়েবটি আসল। দেশে তৃতীয় ওয়েবও যদি আসে, এভাবেই আসবে। সেজন্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ঢেউ প্রতিরোধের জন্যও আমাদের কঠোরভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : নতুন ধরন কি আগের তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয়, কীভাবে সে শক্তি অর্জন করে?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : যেহেতু ভাইরাসটি পরিবর্তিত হয়ে নতুন ধরনে এসেছে, সেহেতু সে অবশ্যই আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি অর্জন করে এসেছে। মানুষের মধ্যে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল, সেটা পাশ কাটিয়ে সে আরও বংশবিস্তারের জন্য নতুন ধরনে গেছে। তার মানে এই ধরনটা হবে আরও বেশি মারাত্মক। তার শক্তিটা থাকবে আগের তুলনায় অনেকগুণ বেশি।
দেখা যাচ্ছে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ৭০ থেকে ৯০ ভাগ বেশি আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে, দ্রুত ছড়ায়। আগে যেমন নাকের ভেতরে গিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করত, তারপর ফুসফুসে যেত; সেটার আর দরকার পড়ে না। তারা এখন সরাসরি ফুসফুসে চলে যায়। ফুসফুসকে সংক্রমিত করে। অর্থাৎ আগে ভাইরাসটি নাকে থাকলে সর্দি, কাশি ও জ্বর হতো; এখন সেগুলো হচ্ছে না। সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের সামান্য মাথাব্যথা, গাব্যথা; পরে সিটি স্ক্যানে দেখা যায় যে তার ফুসফুস ৩০ থেকে ৫০ ভাগ অকার্যকর হয়ে গেছে। ওইদিকে করোনা পরীক্ষাতেও পজিটিভ না এসে বারবার নেগেটিভ আসছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে অবশ্যই অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, যেটা আমরা প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাবে শনাক্ত করতে পারিনি। যেহেতু নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিপরীতে আমাদের কোনো প্রতিরোধক্ষমতা নেই, সেহেতু ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াবে। আর নতুন ভ্যারিয়েন্ট যেটি আসবে, সেটি আগের তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক হবে।
এখন এই সেকেন্ড ওয়েবের সময় যদি আমরা ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে শনাক্ত-মৃত্যু প্রতিদিন বাড়তেই থাকবে। আর যদি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে আমাদের অবশ্যই তৃতীয় ওয়েবের জন্যও কঠোরভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী চলাফেরা করতে হবে। এভাবে অন্তত এক থেকে দুই বছর আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। পরিপূর্ণভাবে মহামারিটি আমাদের থেকে চলে গেলে তবেই আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব। এর আগ পর্যন্ত কথা একটাই, মাস্ক...মাস্ক অ্যান্ড মাস্ক। কোনোভাবেই যেন নতুন ভাইরাসটি আমাদের শরীরের ভেতরে না ঢুকে।
আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে যে আরেকটা থার্ড ওয়েব আসতে পারে, ফোর্থ ওয়েবও আসতে পারে। এমনকি হতে পারে পুরোপুরিভাবে মানুষের উত্থানটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল। যেমন ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরকম আরও কত প্রাণীই এভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : আমাদের একটাই করণীয়, ভাইরাসটি যেন আমাদের শরীরের ভেতর না ঢুকে, সেই ব্যবস্থা করা। সামান্য কয়েকটা কাজেই আমরা ভাইরাসটা প্রতিরোধ করতে পারি। তা হলো- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
আর রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো মানুষকে এই কাজগুলো করাতে বাধ্য করা। যেখানেই জটলা হবে, সেখানেই অ্যাকশন নেওয়া। মাস্ক না পরলে ব্যবস্থা নেওয়া, বিদেশ থেকে কেউ আসলে বাধ্যতামূলক তার কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো যেতে পারে। আইন প্রয়োগ করে হলেও ব্যক্তিগত এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো যেন মানুষ মেনে চলে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, কঠোরভাবে লকডাউন করলে সাধারণ গরীব মানুষ কতদিন না খেয়ে বাঁচবে; তারা তো করোনার ভয়ে ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাবে। সুতরাং তাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।
সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি রোধে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে, টেস্টের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেন, যেদিন টেস্ট বেশি হয়, সেদিন আক্রান্তের হারও বেড়ে যায়। কম টেস্ট হলে আক্রমণের হার তো কমবে। অন্যান্য দেশগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ টেস্ট হচ্ছে, আমরা এত না করতে পারলেও সংখ্যা বাড়াতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। কোনো রোগী যেন চিকিৎসা না পেয়ে মারা না যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : হাসপাতালগুলোতে সিট পাওয়া যাচ্ছে না, দেখা দিয়েছে আইসিইউ সংকট। নতুন করে ফিল্ড হাসপাতালের কথা ভাবা যায় কি না?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : হাসপাতালগুলোতে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না, আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে; এগুলো তো বাস্তবতা। সেবা বাড়াতে হলে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দরকার হলে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ খোলা মাঠকে হাসপাতালে রূপান্তর করতে হবে। এগুলো পরিচালনায় আরও চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দিতে হবে। জনবল না থাকলে হাসপাতাল বানিয়ে লাভ কী?
প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে সরকার গত বছর যে হাসপাতালগুলো করল, সেগুলোর অনেকই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে অসংখ্য যন্ত্রপাতি পড়ে আছে, অথচ হাসপাতালগুলোতে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেলের সামনে মানুষ ভর্তির জন্য ভিড় জমাচ্ছেন, কোনো সিরিয়াল তারা পাচ্ছেন না। রোগীরা অক্সিজেন পাচ্ছেন না, আইসিইউ তো নাই-ই। আইসিইউর অভাবে প্রচুর রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বাড়াতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : শহর এলাকার মতো গ্রামাঞ্চলের মানুষ তত সচেতন নন। স্বাস্থ্যবিধিও মানতে চান না তারা। তাদের জন্য কী করণীয়?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মানতে বাধ্য করা শুধু শহরে নয়, গ্রামেও করতে হবে। সারাদেশের মানুষকে সুরক্ষার ছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা মানুষও যদি অরক্ষিত থাকে, তাহলে পুরো দেশ সুরক্ষিত নয়। আমরা দেখছি, গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। কিন্তু প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে, সর্দি হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। সেগুলো সরকারের হিসাবেও আসছে না। আমরা প্রতিদিন ৬০, ৭০, ৭৫ জনের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মৃত্যুর পরিসংখ্যান এখানে নেই। এই জায়গাগুলোতেও আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।
আমরা যদি টেস্টের সংখ্যা বাড়াই, গ্রামপর্যায়ে যদি এটি নিয়ে যাই, তাহলে গ্রামের মানুষ টেস্টের আওতায় আসবেন। শহরের ওপর চাপও কমবে। এই কাজগুলো সরকারকেই গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : চিকিৎসকদের মধ্যে সংক্রমণের হার কেমন?
অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু : চিকিৎসক-নার্সদের মধ্যে সংক্রমণের হার আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। কারণ হলো, কোভিড ইউনিটে ডিউটি শেষে স্বাভাবিকভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম। কিন্তু আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের এক সপ্তাহ বাসায় থাকার পর আবারও ডিউটিতে যেতে হচ্ছে। তাদের জায়গায় কাজ করার মতো পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট আমাদের চিকিৎসকদের জন্য বেশি ভালনারেবল ও রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য চিকিৎসক সংক্রমিত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে একটা সময় স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। সুতরাং চিকিৎসকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং নতুন করে নিয়োগ দিয়ে তাদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। যারা কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি করছেন বা সরাসরি ল্যাবে কাজ করছেন, তাদের যেন সংক্রমণটা কম হয়, সে লক্ষ্যে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে পর্যাপ্ত দিন তারা যাতে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা মেডিকেলে পর্যাপ্ত সংখ্যক ভাইরোলজিস্ট নেই। ইতোমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন ভাইরোলজিস্ট আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় আমরা কোনোরকম কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে তো চলতে পারে না। আমি অনেকবার বলেছি, ঢাকা মেডিকেলে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভাইরোলজির স্টুডেন্ট নেওয়ার জন্য। সরকারের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার পরও কোথায় যে বিষয়টি আটকে আছে, বুঝতে পারছি না। এ বছরের মধ্যে যদি নিতে না পারি, তাহলে খুবই সিরিয়াস অবস্থার মধ্যে পড়ে যাব। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক ভাইরোলজিস্ট নেই। যারা আছেন, তাদের অনেকেই আইসোলেশনে আছেন।
আমাদের এখানকার দুজন ডাক্তার ঢাকা মেডিকেলে পোস্টেড, অথচ তাদের সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জের ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতালে। যেহেতু ভাইরোলজিস্ট কম, না দিয়েও উপায় নেই। কিন্তু আমাদের এখানে এমনিতেই কম, আরও কমে গেল। এই মুহূর্তে আমাদের প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন, গবেষণা করতে গেলে ভাইরোলজিস্টও প্রয়োজন।
টিআই/এমএআর/