কমছে চিংড়ির রপ্তানি-উৎপাদন, প্রয়োজন উদ্যোগ
সম্ভাবনাময় চিংড়ি খাত এখন অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ধারাবাহিকভাবে কমছে রপ্তানি ও উৎপাদনের পরিমাণ। ফলে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি দেশ হারাচ্ছে রপ্তানি বাজার। অথচ সঠিক পদক্ষেপ নিলে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়িতে রপ্তানি ও উৎপাদন উভয়ই দ্বিগুণ করা যেত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়া, ভেন্নামি চিংড়ি (প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি) উৎপাদনে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় মূলত রপ্তানি কমছে। অন্যদিকে সময়োপযোগী পদক্ষেপের অভাবে কমছে উৎপাদন।
মৎস্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ শাখার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই লাখ ৫২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টনে পৌঁছায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে উৎপাদনের পরিমাণ। সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন দুই লাখ ৩৯ হাজার ২১৩ মেট্রিক টনে ঠেকেছে।
অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া চিংড়ি রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি রপ্তানি হয়। এ সময়ে ৫৩ হাজার ৩৬১ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়, যার বাজারমূল্য ছিল দুই হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে রপ্তানি। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৩৬২.৫২ মেট্রিক টনে ঠেকে। যার বাজারমূল্য তিন হাজার ৮৮.৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত চিংড়ির অধিকাংশই চাষ হয় দক্ষিণের জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। এর বাইরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় লোনাপানি ধরে রেখে স্বল্প পরিমাণে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়।
চিংড়ি উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক ও সময়োপযোগী পদ্ধতিতে চাষ না হওয়া। এছাড়া চাষিদের ঋণ সহযোগিতার পাশাপাশি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থার কথাও বলেন তারা।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করছি, আগামীতে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি দুই-ই বাড়বে। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে।
দুটি হ্যাচারিতে ভাইরাসমুক্ত বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়েছে। আধুনিক চিংড়ি চাষের ওপর চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। ফলে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির উৎপাদনও বাড়বে। এছাড়া বিশ্বে রপ্তানিতে এগিয়ে থাকা ভেন্নামি চিংড়ির জাত নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে ভেন্নামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজ
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক জলাশয়ে চিংড়িচাষ হয়। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে সিংহভাগ চিংড়িই চাষের। তবে উন্মুক্ত জলাশয়ে বেশি পরিমাণ চিংড়ি উৎপাদন হয়। উন্মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল ও প্লাবনভূমি। আর চাষ করা জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, মৌসুমি জলাশয়, বাওড়, চিংড়ি খামার ও পেন কালচার।
দীর্ঘ সময় চিংড়িচাষ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে যুক্ত মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ শাখার উপ-পরিচালক মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিলে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। এর মধ্যে অন্যতম হলো চিংড়ির ঘেরের সুব্যবস্থাপনা ও খনন।
বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য চিংড়িচাষ নিয়ে কাজ করা এ কর্মকর্তা বলেন, চিংড়িচাষিদের আরও আধুনিক ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। ভালোমানের চিংড়ি পোনার পর্যাপ্ততাও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও ওরিয়েন্টাল ফিশ প্রসেসিং অ্যান্ড কালচারাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আব্দুর বাকী মনে করেন, চাইলেই চিংড়ির সেই সোনালী সময় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। চিংড়ি রপ্তানির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে এ উদ্যোক্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা শুধু বিদেশে নয়, দেশেও অনেক বেশি। কিন্তু সেভাবে আমরা উৎপাদন করতে পারছি না।
আন্তর্জাতিক বাজারেও চিংড়ির দাম অনেকটা কম। ফলে আমাদের যে চিংড়ি চাষে খরচ কম পড়বে, সেই চিংড়ি চাষের দিকে যেতে হবে। যেমন- ভেন্নামি, এই জাতের চিংড়ি চাষে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। তারা লাভবানও হচ্ছে।
ফিশ প্রসেসিং অ্যান্ড কালচারাল লিমিটেডের এমডি শেখ মোহাম্মদ আব্দুর বাকী
এছাড়া ভেন্নামি চিংড়ির তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা কমছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘ভেন্নামি’ চাষের বিকল্প কেন নয়
চিংড়ি চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে আয় কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলো কম দামে চিংড়ি উৎপাদন করছে এবং কম দামে বাজারে সরবরাহ করছে। ফলে বাংলাদেশের বাজার হুমকির মুখে পড়েছে। মূলত গলদা ও বাগদা চিংড়ি এ দেশে ব্যাপক চাষ হয়। এটি মানেও উন্নত, দামও বেশি। কিন্তু প্রতিযোগী ভারত ও ভিয়েতনাম বিকল্প জাত ভেন্নামি চাষ করছে। বাগদা চিংড়ির তুলনায় ভেন্নামি চিংড়ির দাম অনেক কম এবং উৎপাদন বেশি হয়।
অপরদিকে বাংলাদেশে সেমি ইনসেন্টিভ প্রযুক্তিতে যে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে তার ৯০ শতাংশ মারা যাচ্ছে আবহাওয়ার কারণে। একই সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওজনে বেশি দেখানোর জন্য চিংড়িতে অপদ্রব্য ঢুকিয়ে (পুশ) বাইরে রফতানি করে। যা বাজার নষ্ট করছে। ফলে রপ্তানি দিনদিন কমছে। ভারত ও ভিয়েতনাম অত্যধিক পরিমাণে ভেন্নামি চিংড়ি উৎপাদন করে। বাগদা চিংড়ির চেয়ে ভেন্নামি চিংড়ির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম। ফলে বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির রপ্তানি মূল্য যেখানে প্রতি পাউন্ড ৭ ডলার, সেখানে ভেন্নামি চিংড়ি রপ্তানি হয় ৫ ডলারে। পাউন্ডে পার্থক্য ২ ডলার।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী যত চিংড়ি রপ্তানি হয় তার ৭৭ শতাংশ ভেন্নামি প্রজাতির। চিংড়ি রপ্তানি বাড়াতে এ প্রজাতির চিংড়ি উৎপাদনের বিকল্প নেই।
পরিবেশবান্ধব চিংড়িচাষ সম্প্রসারণে অধিদপ্তর যা বলছে
দেশে বর্তমানে সব ধরনের উৎস থেকে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২.২১ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চিংড়ি খামার থেকে ০.৮৭ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়। খামার থেকে উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির সিংহভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়।
বর্তমানে উপকূলীয় লবণ পানিতে অন্যান্য ফসল, যেমন- ধান, মাছ, লবণ ইত্যাদির সঙ্গে প্রায় ১.৭০ লাখ হেক্টর ঘের/খামারে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। জোয়ারের পানির সঙ্গে অন্য প্রজাতির চিংড়িও এসব ঘেরে প্রবেশ করে, যা সাথী ফসল হিসেবে উৎপাদিত হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় স্বাদু পানির ০.৪৭ লাখ হেক্টর পুকুর, ধানক্ষেত ও ঘেরে গলদা চিংড়ির চাষ হয়। চিংড়িচাষ এলাকায় চিংড়ি ছাড়াও প্রায় ০.০৪ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছ উৎপাদন হয়।
দেশে উপকূলীয় চিংড়ি চাষের এলাকা সম্প্রসারণের তেমন সুযোগ নেই। স্থির মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা (সারণী-৩) অর্জনের জন্য আগামী ২০২০-২১ সাল নাগাদ দেশব্যাপী স্বাদু পানির চিংড়িচাষ এলাকা সম্প্রসারণ করে ২.৪০ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে হবে। পরিবেশবান্ধব চিংড়িচাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও লাগসই সম্প্রসারণ সেবা প্রদান, চাষি প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী খামার পরিচালনা ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলে ২০২০-২১ সালে চিংড়ি খামার থেকে মোট উৎপাদন প্রায় ২.১০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে। চিংড়িচাষ এলাকা সম্প্রসারণের পাশাপাশি হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ফলে চিংড়ি রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করে মৎস্য অধিদপ্তর।
একে/জেডএস/এমএআর