শোকজ-বহিষ্কারের আড়ালে অপ্রকাশিত ‘বড় শাস্তি’
দলের বিরুদ্ধে অবস্থান, সিদ্ধান্ত অমান্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ যেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের জন্য ডাল-ভাত। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে শেষ হওয়া প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এর আগের নির্বাচনগুলোতেও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থিতা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা দলীয় শৃঙ্খলার চরম লঙ্ঘন। কিন্তু কেন বারবার এমনটি হচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে? শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কি শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হয়তো কোনো অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীরা। যেখানে বড় শাস্তি হওয়ার কথা সেখানে সাধারণ ক্ষমার মধ্য দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে, দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, শাস্তি ঠিকই হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শোকজ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে অপরাধের গুরুত্ব বুঝে দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। এগুলো ‘প্রকাশিত শাস্তি’। এর বাইরেও এক ধরনের শাস্তি বিদ্যমান আছে। সেটি হলো ‘অপ্রকাশিত শাস্তি’। এটি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর।
সম্প্রতি শেষ হয়েছে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দেয়নি। একই সঙ্গে নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে এমপি-মন্ত্রীর ছেলে, স্ত্রী বা মেয়ে এমনকি তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে— এমন নির্দেশনাও দেওয়া হয়। অথচ, বাস্তবতা হলো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া দলের সেই সিদ্ধান্ত কেউ মানেননি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কী শাস্তি হবে, সেই আলোচনা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। কেউ বলছেন, সাধারণ ক্ষমা পাবেন। আবার কেউ বলছেন, কোনো শাস্তিই হবে না তাদের। তবে দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, শাস্তি অবশ্যই হবে। সেটি প্রকাশিত হতে পারে, আবার নাও পারে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দেয়নি। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে এমপি-মন্ত্রীর ছেলে, স্ত্রী বা মেয়ে এমনকি তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে— এমন নির্দেশনাও দেওয়া হয়। অথচ, বাস্তবতা হলো হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া দলের সেই সিদ্ধান্ত কেউ মানেননি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কী শাস্তি হবে, সেই আলোচনা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। কেউ বলছেন, সাধারণ ক্ষমা পাবেন। আবার কেউ বলছেন, কোনো শাস্তিই হবে না তাদের। তবে দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, শাস্তি অবশ্যই হবে। সেটি প্রকাশিত হতে পারে, আবার নাও পারে
আরও পড়ুন
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উদ্ধৃতি টেনে তারা বলেছেন, ‘যারা ডিসিপ্লিন ভাঙবে, সময় মতো তাদের কোনো না কোনো শাস্তি পেতেই হবে।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শাস্তি কোনো না কোনোভাবে দেওয়া হয়। তাদের শোকজ করা হয়, সদস্য পদ বাতিল করা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিষ্কার করা হয় অথবা আজীবনও বহিষ্কার করা হয়। আবার কখনও কখনও গণভাবে ক্ষমাও করে দেওয়া হয়। এগুলো সবাই জানতে পারেন। যা প্রকাশ্যে ঘটে।’
“আবার অপ্রকাশ্যে অনেক কিছু্ই ঘটে। যেমন- দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার সময় যোগ্যতা আছে, কিন্তু দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে তাকে মনোনয়ন নাও দেওয়া হতে পারে। সম্মেলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার মতো যোগ্যতা আছে, কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সেই পদ থেকে তিনি বঞ্চিত হতে পারেন। এমনকি তার পদমর্যাদা ‘অবনমন’ও করা হতে পারে। এগুলো কিন্তু বড় শাস্তি। দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে কাজ হচ্ছে।”
দলের সিনিয়র নেতাদের মতে, ‘প্রকাশিত’ শাস্তির চেয়ে ‘অপ্রকাশিত’ শাস্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। শোকজ কিংবা বহিষ্কার করলে সেটি কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু অপ্রকাশিত শাস্তির বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেন না। সঠিক সময়ে সঠিক শাস্তি কৌশলে প্রয়োগ হরা হয়। হয়তো অনেক সময় সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু দলের বড় পদ-পদবি এমনকি মন্ত্রী-এমপি হওয়ার সুযোগ থেকে সুকৌশলে তাকে বঞ্চিত করা হয়।
আরও পড়ুন
বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা, গাজীপুর মহানগরের এক নেতাকে অপ্রকাশিত শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আবার একাদশ মন্ত্রিসভার অনেককে বর্তমান মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি— এটিও এক ধরনের শাস্তি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য এবং ব্যক্তির অপকর্মের জন্য ‘অপ্রকাশিত’ এমন শাস্তি সবসময় দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, জানান তারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনৈতিক দল দুভাবে শাস্তি দেয়। একটি প্রকাশিত শাস্তি, আরেকটি অপ্রকাশিত। প্রকাশিত শাস্তি মিডিয়ায় আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে শোকজ করা হয়। শোকজের জবাব আসার পর সাময়িক বহিষ্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়। স্থায়ী বহিষ্কারের সুযোগ কমই থাকে। সচরাচর সাময়িক বহিষ্কারটাই সামনে আসে।
“মানুষ নিজ সম্মানকে বেশি প্রাধান্য দেয়। বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা। তারা সম্মানকে খুব ভয় পান। দলের দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আপনি এমপি-মন্ত্রী হবেন, আপনার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, দল যদি আপনাকে শোকজ করে আর সেটি যদি পত্রিকায় আসে, আপনি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবেন, এটিও এক ধরনের শাস্তি। আবার এর ভিন্নতাও আছে। সেটি বিভিন্ন মেয়াদের হয়ে থাকে। একজন মানুষ খুন করলে তার শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন বা ফাঁসি। আবার একজন মানুষ আরেকজনকে ঘুষি মারলে তার শাস্তি তো যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হবে না। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের মাত্রার ওপর নির্ভর করে তার শাস্তির পরিমাণ। একজন নেতা বা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ কোনো কারণে শোকজ খেলে তিনি এক ধরনের শাস্তি পেয়ে যান। পরবর্তীতে অপরাধের গুরুত্ব বুঝে তাকে সাময়িক বহিষ্কার বা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।”
অপ্রকাশিত শাস্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দলের শৃঙ্খলা যিনি ভঙ্গ করেন, তিনি এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকেন। কারণ, দলীয়প্রধান তার প্রতি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন অথবা সিনিয়র নেতারা বিরাগভাজন হয়েছেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, দলের প্রতি তার সার্ভিস বা ডেডিকেশন অনুযায়ী তিনি হয়তো মন্ত্রী বা দলের আরও সিনিয়র পদপ্রত্যাশী ছিলেন, সেটি থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন। এটিও এক ধরনের বড় শাস্তি। যা অপ্রকাশিত শাস্তি হিসেবে বিবেচিত। প্রকাশিত শাস্তি শুধু মিডিয়ায় আসে, আর অপ্রকাশিত শাস্তি অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়।’
আওয়ামী লীগের এ সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় হয়তো জনপ্রিয়, আমি হয়তো নমিনেশন পাব— এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গেল, চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো না। অথচ, মনোনয়ন পাওয়ার জন্য আমাকে অনেক বেশি কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। এটি কিন্তু বড় ধরনের শাস্তি। দলের শাস্তিগুলো বিভিন্ন মাত্রার হয়ে থাকে। দেখা গেল, দীর্ঘদিন আমি রাজনীতি করছি কিন্তু কিছুই হতে পারলাম না। অথচ, আমার শিষ্য মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে, আমি পেছনের সারিতে বসে আছি। নিশ্চয়ই আমি এমন কোনো কাজ করেছি যার কারণে আমার ওপর দলীয় হাইকমান্ড অসন্তোষ ছিল, আমাকে ওই পদ দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ‘প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা’ সম্পর্কিত বিষয়ে বলা আছে, কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিলে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ তাহার বিরুদ্ধে যে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।
গঠনতন্ত্রে আরও বলা আছে, সংগঠনের যে কোনো শাখা তাহার যে কোনো কর্মকর্তা বা সদস্যকে দলের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের জন্য স্ব-স্ব পদ বা দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারিবে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন শাখার অনুমোদন প্রয়োজন হইবে এবং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাখার সাধারণ সভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। যে কোনো বহিষ্কারের বিষয়ে জেলা কমিটির সুপারিশের পর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক তদন্তে দোষীসাব্যস্ত হইলেই কেবল চূড়ান্তভাবে বহিষ্কৃত হইবে।
অনুচ্ছেদ ৪৭ এর (১০) বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেহ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হইলে দল হইতে সরাসরি বহিষ্কার হইবেন এবং যাহারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করিবেন, তাহারা তদন্তসাপেক্ষে মূল দল বা সহযোগী সংগঠন হইতে বহিষ্কৃত হইবেন।
এদিকে, গত ৬ মে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, যারা দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে, সময় মতো তাদের কোনো না কোনো শাস্তি পেতে হবে। আমাদের অ্যাকশন কোনো না কোনোভাবে থাকেই। ৭০ জনের বেশি সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন না দেওয়া, আগের মন্ত্রিপরিষদের ২৫ জনকে নতুন কেবিনেটে না রাখা কি এর উদাহরণ নয়?
এমএসআই/