মন যা চায় তাই করেন ইসি কর্মকর্তা ফরিদুল!
নাগরিকদের নানা কাজে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। তথ্যের গরমিল থাকায় অনেককে এটি সংশোধন করতে হচ্ছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই পত্রটি সংশোধন করা বাংলাদেশে একটা দুরূহ কাজ হয়ে উঠেছে।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট বিধি ও পদ্ধতি মেনে এনআইডি সংশোধন করতে বাধ্য হলেও তাদের কেউ কেউ নাগরিকদের অকারণে হয়রানি করেন। এমন বহু অভিযোগ বছরের পর বছর করে আসছেন অনেক নাগরিক। সম্প্রতি পরিচয়পত্র সংশোধনের সময় বিনা কারণে ‘অযৌক্তিক কাগজপত্র’ চেয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। যাদের সবারই এনআইডি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৭-০৮ সালে যখন প্রথম এনআইডির কার্যক্রম শুরু হয় তখন কেউ জানতেন না জাতীয় পরিচয়পত্রের এ কার্ড ভবিষ্যতে ‘জাতীয় দলিল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি যদি সাধারণ মানুষ বুঝতেন তাহলে শুরুতেই সবাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেন। মূলত, ওই সময় নির্বাচন কমিশনের প্রচারের অভাবে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের এনআইডিতে কিছু না কিছু ভুল রয়ে গেছে। যেগুলো সংশোধন করতে গিয়ে নিয়মিত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারাও এনআইডি সংশোধনের নামে নাগরিকদের দিনের পর দিন ভোগান্তিতে ফেলছেন।
২০০৭-০৮ সালে যখন এনআইডির প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় তখন কিন্তু নির্বাচন কমিশন বা সরকার থেকে নাগরিকদের এনআইডির গুরুত্বের বিষয়ে সেভাবে সচেতন করা হয়নি। ফলে নাগরিকরা মনগড়া তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি একজনের তথ্য আরেকজনও দিয়েছিলেন। কার্ডে বয়স, নাম, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য রয়ে যায়। নাগরিকরা যখন বুঝতে পারেন এনআইডি সংশোধন ছাড়া সেবা মিলবে না, তখন অনলাইনে আবেদন করে এনআইডি সংশোধন করতে নির্বাচন কমিশনের অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকেন।
আরও পড়ুন
তাদেরই একজন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার কাজী রুবেল। ২০০৮ সালে করা নিজের এনআইডিতে ভুল থাকায় সম্প্রতি সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে মিল রেখে বয়স, মায়ের নামের আংশিক পরিবর্তনসহ মায়ের এনআইডি নম্বর যুক্ত করেন। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক পাস থাকলেও এখন তিনি সপ্তম শ্রেণি উল্লেখ করতে চাচ্ছেন। তার আবেদনটির যথাযথ যৌক্তিকতা থাকলেও সংশোধন না করে অযৌক্তিক কাগজপত্র চেয়েছেন ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম।
যেসব কাগজপত্র চেয়েছেন আঞ্চলিক কর্মকর্তা
কাজী রুবেল তার এনআইডি সংশোধনী আবেদনে পাঁচ বছর বয়স, মায়ের নাম কাজী শামীমা আক্তার থেকে শামীমা আক্তার এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে সংশোধনী আবেদনে অনলাইন জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, মায়ের এনআইডি, পারিবারিক সনদ, ম্যাজিস্ট্রেট হলফনামা এবং ক্ষমার দরখাস্ত দিয়েছেন। আবেদনকারী শিক্ষাগত যোগ্যতা সপ্তম শ্রেণি চাওয়ার পরও ফরিদুল ইসলাম এসএসসি সনদ, প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড চেয়ে আবেদনটি ফেরত পাঠিয়েছেন।
তবে ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সংশোধনী আবেদনে এসব কাগজপত্র চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলতেই এমন কাগজপত্র চান আঞ্চলিক কর্মকর্তা ফরিদুল।
তদন্ত প্রতিবেদন পজিটিভ থাকলেও ফাইল যায় ডিজির কাছে
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার আরেফিন হৃদয়। তিনি গত বছর নিজ এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেন। সংশোধনী আবেদনে তিনি পিতার নাম আ. বাখির থেকে গিয়াস উদ্দিন, মায়ের নাম মো. ঝরনা থেকে ঝড়না বেগম, শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং পেশা ছাত্র থেকে শ্রমিক চেয়েছেন। সংশোধনী আবেদনের সঙ্গে অনলাইন জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদ, ওয়ারিশা সনদ, মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র, পিতার জন্ম ও মৃত্যুর সনদ, ম্যাজিস্ট্রেট হলফনামা, স্ত্রী ও শ্বশুরের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
হৃদয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুরুতে এনআইডি উইংয়ের উপপরিচালক থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে তদন্তের জন্য পাঠান। থানা নির্বাচন কর্মকর্তা সরেজমিনে তদন্ত করে কাগজপত্রের সঙ্গে আবেদনকারীর চাহিত সংশোধনের মিল রয়েছে বলে সুপারিশ করেন। এরপরই বাধে বিপত্তি।
তদন্ত রিপোর্ট পজিটিভ থাকার পরও নিজের এখতিয়ারভুক্ত সংশোধনী আবেদনের নিষ্পত্তি না করে এনআইডি মহাপরিচালকের কাছে ফাইল ফরোয়ার্ড করে দেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফরিদুল। পজিটিভ থাকা বেশিরভাগ ফাইলের ক্ষেত্রে তিনি ডিজির দ্বারস্থ হন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন পজিটিভ আসার পরও ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম এসএসসি সনদ চেয়ে আবেদন ফেরত পাঠান। শিক্ষাগত যোগ্যতা ডাউন চাওয়ার পরও তিনি এ আবেদনে এসএসসি সনদ চেয়েছেন। তাহলে কি মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্যই...
প্রতিবেদনে কী জানিয়েছেন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা
আবেদনকারী আরেফিন হৃদয়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে পিতার নাম আ. বাখিরের স্থলে গিয়াস উদ্দিন, মাতার নাম মো. ঝরনার স্থলে ঝড়না বেগম, শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিকের স্থলে চতুর্থ শ্রেণি এবং পেশা ছাত্র/ছাত্রীর স্থলে শ্রমিক চেয়ে অনলাইনে আবেদন করেছেন।
থানা নির্বাচন কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবেদনকারীর সব দলিলাদির মূল কপি দেখা হয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আবেদনকারীর ডাটাবেজে শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক পাস। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেননি, চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছেন মর্মে হলফনামা করে সে মোতাবেক সংশোধন চেয়েছেন। আবেদনকারী জানান, তিনি ভোটার হওয়ার সময় ভুলক্রমে শ্বশুরের নাম পিতা হিসেবে ব্যবহার করে ভোটার হয়েছেন। তার দাখিলকৃত জন্মসনদ, নাগরিকত্ব সনদ, ওয়ারিশান সনদ, পিতার মৃত্যুর সনদ, পিতার জন্মসনদ ও হলফনামার সঙ্গে চাহিত তথ্যের মিল রয়েছে। এ অবস্থায় আবেদনকারীর ডাটাবেজে শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক পাস থাকায় এবং সার্বিক পর্যালোচনায় তার চাহিত তথ্যাবলি সংশোধনের জন্য মহোদয়ের সদয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে ফরিদুলের বিরুদ্ধে
ইসি কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত প্রতিবেদন পজিটিভ আসার পরও ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম এসএসসি সনদ চেয়ে আবেদন ফেরত পাঠান। শিক্ষাগত যোগ্যতা ডাউন চাওয়ার পরও তিনি এ আবেদনে এসএসসি সনদ চেয়েছেন। তাহলে কি মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্যই আঞ্চলিক কর্মকর্তা ফরিদুল অযৌক্তিক কাগজপত্র চাচ্ছেন— প্রশ্ন রাখেন ওই কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আঞ্চলিক কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলামের কাছে এনআইডি সংশোধনের জন্য গেলে নাগরিকরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। এ কর্মকর্তা শুধু সাধারণ জনগণকে নয়, এনআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থাৎ অনুবিভাগটির মহাপরিচালককেও নানাভাবে ভোগান্তিতে ফেলেন। নিজের এখতিয়ারভুক্ত ফাইলের দায়িত্ব না নিয়ে এনআইডির মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দেন। ফলে সেবা নিতে আসা সাধারণ জনগণ ফাইলের পেছনে দিনের পর দিন ছুটছেন।
তিনি আরও বলেন, ফরিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তারপরও কমিশন তার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। কারণ, তিনি বেশিরভাগ সময় সচিবালয়ে কমিশনারসহ বড় বড় স্যারদের কাছে গিয়ে বসে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ফরিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ আছে। তিনি ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্ব পাওয়ার পর রাজশাহী থেকে উনার পছন্দের কম্পিউটার অপারেটর নিয়ে এসেছেন। যিনি বর্তমানে একই টেবিলে ফরিদুল ইসলামের চেয়ারের পাশে বসেন। কারণ, রাজশাহীতে উনি যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন তিনি এ কম্পিউটার অপারেটরের মাধ্যমে সব লেনদেন করতেন বলে অভিযোগ আছে। এখানে আসার পরও তিনি ওই কম্পিউটার অপারেটরকে দিয়ে অর্থ লেনদেন করেন। যারা ওই ছেলের মাধ্যমে আসেন তাদের এনআইডি সংশোধন হয়ে যায়। ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়েই ফরিদুল প্রথম তিন মাসে বিপুল অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে রেকর্ড সংখ্যক এনআইডি সংশোধন করেছিলেন। এ বিষয়ে সচিবালয়ে জানাজানি হওয়ার পর তিনি সাবধান হয়ে যান।
বর্তমানে তিনি আরও ভালো পদায়ন পেতে নিজ অফিসে কাজ না করে বেশিরভাগ সময় সচিবালয়ে পড়ে থাকেন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
সংশোধনী আবেদনে ‘অযৌক্তিক’ কাগজপত্র চাওয়া প্রসঙ্গে ফরিদুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, তাই আমি চেয়েছি।’
শিক্ষাগত যোগ্যতা ডাউন চাওয়ার পরও কোন আইনে এসএসসি সনদ, প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড চেয়েছেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি এটা বলতে পারব না। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা যৌক্তিক, তাই চেয়েছি।’
এরপর ‘আপনি ভালো থাকবেন’ বলে ইসির এ কর্মকর্তা ফোন রেখে দেন।
অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব : ইসি
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এনআইডি সংশোধনে আইনের বাইরে মনগড়া কিছু করার সুযোগ নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতা ডাউন চাওয়ার পরও শিক্ষার সনদ চাওয়ার কথা না। তবে এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে, সেটি আমরা খতিয়ে দেখব।’
কয়েক মাস এনআইডির ভারপ্রাপ্ত ডিজির দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার আরও জানান, ঢাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা তার এখতিয়ারভুক্ত বেশিরভাগ ‘গ’ ক্যাটাগরির সংশোধনের আবেদনের ফাইল ডিজির কাছে পাঠিয়ে দেন। অথচ, ‘গ’ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব তার। কিন্তু তিনি সেটি করেন না।
এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় এনআইডি সংশোধনের জন্য অনেক বেশি আবেদন পড়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত দ্রুততার সঙ্গে এনআইডির সেবা প্রদানে সচেষ্ট। তবে, সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে বিলম্ব বা হয়রানি বা অসংগতি সম্পর্কিত অভিযোগ পাওয়া গেলে অথবা কমিশনের নজরে এলে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
‘এনআইডি সংশোধনে নির্দিষ্ট বিধি ও পদ্ধতি আছে। প্রত্যেকটি এনআইডির সংশোধনী আবেদন সেভাবেই বিবেচনা করার কথা। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার অযৌক্তিক কাগজপত্র চেয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার প্রশ্নই আসে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কমিশন থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
এসআর/এমজে