ফাঁকা অর্ধশতাধিক পদ, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব!
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ দলের বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদ ফাঁকা রয়েছে। নেতাদের মৃত্যু, পদত্যাগ, অন্য দলে যোগদান কিংবা পদোন্নতির কারণে অর্ধশতাধিক পদ বছরের পর বছর শূন্য থাকলেও তা পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বিএনপি কি যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে পারছে না?
দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রে শূন্য পদ পূরণ করতেই হবে— এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণত কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন হয়। পরবর্তীতে শূন্য পদগুলো পূরণ হয়। কাউন্সিলে দলের চেয়ারপারসনকে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি চাইলে যে কোনো সময় যে কাউকে দলে পদায়ন করতে পারেন। শূন্য পদগুলো পূরণের উদ্যোগও নিতে পারেন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে দলের চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তের ওপর।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ ফাঁকা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, হান্নান শাহ ও তরিকুল ইসলাম মারা গেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতে পারছেন না ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। এছাড়া দীর্ঘদিন অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে আটক আছেন স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। এ হিসাবে স্থায়ী কমিটির সাতটি পদই এখন অকার্যকর।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে শূন্য পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বলছেন, দলটির নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গত ১২ বছরে একটা আন্দোলনেও সফলতা আসেনি। সরকার পতনের আন্দোলন থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন, সবখানে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে
৩০ সদস্যের ভাইস চেয়ারম্যান পদের মধ্যে বর্তমানে ১৩টি ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে কেউ মারা গেছেন, কেউ আবার দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। অন্যরা অসুস্থ কিংবা বিদেশে পলাতক থাকায় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। মারা গেছেন সাদেক হোসেন খোকা, ব্যারিস্টার মো. আমিনুল হক, আবদুল মান্নান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে পলাতক আছেন কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন (কায়কোবাদ), ড. ওসমান ফারুক ও শাহজাহান সিরাজ।
দল থেকে পদত্যাগ করেছেন এম মোর্শেদ খান, মোসাদ্দেক আলী ফালু ও ইনাম আহমেদ চৌধুরী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন ইনাম আহমেদ। এছাড়া দুই ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে দীর্ঘদিন অসুস্থ আছেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পদসহ বিএনপির ৫০২ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ৫০টির মতো পদ ফাঁকা রয়েছে। নির্বাহী কমিটির নেতাদের মধ্যে মারা গেছেন- আইনবিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক বদরুজ্জামান খসরু, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান, সহ-স্থানীয় সরকার সম্পাদক আমজাদ হোসেন সরকার, নির্বাহী কমিটির সদস্য শফিউল বারী বাবু, আহসান উল্লাহ হাসানসহ আরও কয়েকজন নেতা।
দল থেকে পদত্যাগ করেছেন কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক মো. সাহাব উদ্দিন, বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সহ-সম্পাদক ও সংগীতশিল্পী মনির খান, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. ফাইয়াজ শুভ, নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী আসগর লবি, মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া। দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক আছেন হত্যা মামলার আসামি ও বিএনপির ক্ষুদ্র ঋণবিষয়ক সম্পাদক এম এ কাইয়ুম।
শূন্য পদগুলো পূরণ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে কোনো কারণে পদগুলো খালি হলে সাধারণত পরবর্তী কাউন্সিলে সেগুলো পূরণ করা হয়। তার আগে সম্ভব হয় না। তবে, চেয়ারপারসন যদি চান সেখানে কাউকে পদায়ন করতে পারেন। কাউন্সিলে তাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা নেই যে কাউকে পদ দেবে বা কাউকে বাদ দেবে।’
‘এখন বাস্তবতা হচ্ছে, গত দেড় বছরের মতো দেশে করোনা চলছে। আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রেখেছি। সভা-সমাবেশ সবকিছু বন্ধ। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে কাউন্সিল করব? ফলে এ মুহূর্তে কাউন্সিলের বিষয়টি আসতে পারে না।’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শূন্য পদগুলো পূরণের একমাত্র ক্ষমতা দেওয়া আছে দলের চেয়ারপারসনকে। এখন তিনি যেহেতু সেই দায়িত্ব পালন করছেন না, সেই ক্ষমতা আছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। তিনি চাইলে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যদি শূন্য পদ পূরণ নিয়ে আমাদের কোনো মতামত চান, সেটা আমরা দিতে পারি। তিনি কোনো দায়িত্ব দিলে সেটা পালন করতে পারি। কিন্তু পদগুলো পূরণের উদ্যোগ আমরা কোনোভাবেই নিতে পারি না।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শূন্য পদগুলোর মধ্যে কয়েকটি পূরণ করা হয়েছে। যেমন সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামকে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সম্পাদক করা হয়েছে। এভাবে আরও কয়েকটি পদ পূরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ ফাঁকা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, হান্নান শাহ ও তরিকুল ইসলাম মারা গেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতে পারছেন না ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। এছাড়া দীর্ঘদিন অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে আটক আছেন স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। এ হিসাবে স্থায়ী কমিটির সাতটি পদই এখন অকার্যকর
তবে বিএনপির নেতারা মনে করছেন, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে শূন্য পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বলছেন, দলটির নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গত ১২ বছরে একটা আন্দোলনেও সফলতা আসেনি। সরকার পতনের আন্দোলন থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন, সবখানে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। বিএনপিতে নেতার অভাব না থাকলেও মেধাসম্পন্ন যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যারা বিএনপির সমালোচক, এটা যে কেউ হতে পারেন। রাজনীতিবিদরা হতে পারেন, মিডিয়া হতে পারে, তারাই এমন কথা বলছেন। এটা একেবারে ভুল কথা। বিএনপি মোট পাঁচ-ছয়বার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এখনও বিএনপি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল। এখনও বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে যারা আছেন, তারা এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সুতরাং এ ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে না।
তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছার অভাবে বিএনপির শূন্য পদগুলো পূরণ হচ্ছে না। আমাদের দলের নেতারা তো এখন একে-অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত। স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার মতো কয়েকজন নেতা দলে আছেন। কিন্তু তারা কেউ আঞ্চলিকতা, কেউ সংস্কারপন্থী হওয়ায় দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে আছেন।
ওই নেতা প্রশ্ন রাখেন, দলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব না থাকলে সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন— সবকিছুতে কেন আমরা ব্যর্থ। অথচ এ সময়ে আমাদের চোখের সামনে ‘কোটা’ ও ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন’ সফল করেছে বাচ্চা বাচ্চা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আসলে আমাদের নেতাদের মধ্যে ‘অন্যরা কিছু করে দেবে, আর আমি খাব’— এমন প্রবণতা বেশি।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে খালেদা জিয়াকে পুনরায় চেয়ারপারসন আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করে কমিটি গঠিত হয়। তিন বছর মেয়াদের এ কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয় ২০১৯ সালের মার্চে। কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি।
এএইচআর/এমএআর/