প্রবাসী আয়ে আশার আলো, মহামারিতেও রেকর্ড রেমিট্যান্স
২০২০ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলার
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছাড়িয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার
দেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক যখন খারাপ অবস্থায় তখন আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসীদের আয়। মহামারি সংকটের মধ্যেও বেড়েছে রেমিট্যান্স। সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে দুই হাজার ১৭৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি; (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)। যা একক বছরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ।
এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১৯ সালে, এক হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নগদ প্রণোদনা ও করোনায় বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী মহামারিতে প্রবাসীরা একধরনের অনিশ্চয়তার কারণে জমানো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে সংকটের মধ্যেও দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। তবে প্রবাসী আয়ের এ ইতিবাচক ধারা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে— বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। প্রবাসীরা দেশে ১০০ টাকা যার অ্যাকাউন্টে পাঠাচ্ছেন তিনি ১০০ টাকার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে ১০২ টাকা তুলতে পারছেন। পাঁচ হাজার ডলার অর্থাৎ পাঁচ লাখ টাকা আয় কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা বাবদ তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত করে অনেক ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে আরও ১ শতাংশ বেশি প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ কেন বাড়ছে
‘করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মূল ভূমিকা পালন করছে রেমিট্যান্স’— এমনটি মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- বিশ্বব্যাপী মহামারিতে প্রবাসীরা একধরনের অনিশ্চয়তার কারণে জমানো টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকে বেকার হয়ে দেশে ফিরে আসছেন। এছাড়া সরকারের প্রণোদনা থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান এবং মহামারির কারণে হুন্ডির চাহিদা কম হওয়ায় প্রবাসীরা দেশে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। আমদানি-রপ্তানি মন্দার মধ্যে একমাত্র রেমিট্যান্সই স্বস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতি শক্ত অবস্থায় দাঁড়াবে।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসবে ২০ বিলিয়ন ডলার। মূলত ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়ায় কোভিডের মধ্যেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ
এদিকে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
সারাবিশ্বে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। যে হারে প্রবাসীরা দেশে এসেছেন সেই হারে কিন্তু যেতে পারেননি। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। এমন পরিস্থিতি কতদিন থাকে এটাই দেখার বিষয়। তাই যেসব দেশে প্রবাসীরা কর্মহীন হয়েছেন বা সমস্যায় আছেন, ওইসব দেশে কূটনৈতিকভাবে বিষয়গুলোর সমাধান প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
করোনাভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার হার ৭১ ভাগ কমেছে বলে জানিয়েছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। মহামরির সময়ে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তারা আর ফেরত যেতে পারেননি। এসব অভিবাসী ও তাদের পরিবার এখন বিপন্ন জীবনযাপন করছেন। এর প্রভাব পড়তে পারে সামনের বছরের রেমিট্যান্সের ওপরে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফেরত এসেছেন তিন লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন কর্মী। তাদের মধ্যে ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারী। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সাত লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজের জন্য গেলেও এ বছর গেছেন দুই লাখের কম মানুষ।
বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ
রেমিট্যান্স বাড়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও (রিজার্ভ) সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। ২০২০ সাল শেষে এ মজুতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে, যা এক বছর আগের একই সময় ছিল ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। যা আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অন্যতম মাইলফলক। নতুন একটি বছরের শুরুতে অবশ্যই জাতির জন্য এটি অত্যন্ত সুখকর ঘটনা। অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কোভিড-১৯ এর মধ্যেও রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রেমিট্যান্সের অন্তঃপ্রবাহ।
১২ মাসের রেমিট্যান্স
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৩ কোটি ৮৪ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৫ কোটি ২০ লাখ, মার্চে ১২৭ কোটি ৬৩ লাখ, এপ্রিলে ১০৯ কোটি ৩০ লাখ, মে’তে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ, জুনে ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ, জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ, আগস্টে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ, সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ১০ লাখ, অক্টোবরে ২১০ কোটি ২২ লাখ, নভেম্বরে ২০৭ কোটি ৮৭ লাখ এবং ডিসেম্বরে ২০৫ কোটি ডলার।
বছরভিত্তিক রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সে আসে এক হাজার ৮৩৩ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে এসেছিল এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে এসেছিল এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার। ২০১৫ সালে আসে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি ডলার।
অর্থবছরভিত্তিক রেমিট্যান্স
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণের রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল। তারও আগে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। ওই সময় রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আসে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
এসআই/এমএআর/