বিএনপির গন্ধ পেলেই ওসির তালিকা থেকে বাদ, দেওয়া হতো ‘বাবর-তারেক’ ট্যাগ

বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী পদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) এ পদটি ছিল অনেক বেশি লোভনীয়। বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নিয়োগ দেওয়া হতো ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ দেখে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বহু কর্মকর্তা তাই চাকরিজীবনে ওসি হতে পারেননি।
দেশের সব থানার ওসি পদে সাধারণত পুলিশের ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ। বিএনপির ‘গন্ধ’ পেলেই ওসির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হতো যোগ্য কর্মকর্তাদের। এছাড়া দেওয়া হতো ‘বাবর-তারেক’ ট্যাগ।
ডিএমপির কয়েকজন ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যারা ওসি হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই শুধু আওয়ামী পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে দায়িত্ব পেয়েছেন। ওসি বানানোর ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বা যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়নি। শুধু নিজে বা পরিবার নয়, আত্মীয়-স্বজনের কেউও যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতেন সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তাকে ওসি পদ দেওয়া হতো না।
আরও পড়ুন
যেসব পুলিশ সদস্যের বয়স ৫৪ বছর বা তার বেশি তারা ওসি হতে পারবেন না বলে পুলিশে লিখিত একটি নীতিমালা রয়েছে। এটি ছাড়া আর তেমন কোনো নীতিমালা নেই। দেশের থানাগুলোতে ওসি নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু প্রাধান্য পায় কমিশনার (মেট্রোপলিটন ও শহরে) ও স্ব স্ব রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) ব্যক্তিগত অভিমত। তবে যাদের চাকরি বিএনপি-জামায়াতের আমলে হয়েছিল, তাদের আগেই বাদ দেওয়া হতো ওসি হওয়ার তালিকা থেকে।
ঢাকার ওসি নিয়োগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো ডিএমপির ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশনের (আইএডি) রিপোর্টকে। এতে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স, অর্গানাইজড অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ, সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, পরিবহন বিভাগ, ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ফোর্স বিভাগ, পিআর অ্যান্ড এইচআরডি বিভাগ, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, ক্রাইম বিভাগ, অপারেশন বিভাগ, সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ বিভাগ, স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ, আইএডি বিভাগ, লজিস্টিক, প্রসিকিউশন বিভাগের শতাধিক ইন্সপেক্টরের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হতো।
আওয়ামী লীগের আমলে ইন্সপেক্টরদের নিয়ে আইএডির করা একটি প্রতিবেদন এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে। এতে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শী পরিবার, এমনকি এই মতের আত্মীয়-স্বজন থাকলেই তাকে ‘বিএনপিপন্থি’ হিসেবে রিপোর্ট দেওয়া হতো। ওসি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল এবং ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত পুলিশে যোগদান করা কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হতো। এসব কর্মকর্তা ছাড়াও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ২০০৫ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নিয়োগ দেওয়া ‘স্পেশাল ব্যাচ’ খ্যাত ৮২২ জনকে চিহ্নিত করে বাদ দেওয়া হয়।
ওসি নিয়োগ নিয়ে আইএডির একটি রিপোর্টে ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) পশ্চিম বিভাগের একজন ইন্সপেক্টরের ফাইল যাচাই করে ঢাকা পোস্ট। তার বাড়ি দিনাজপুরে। ওই কর্মকর্তার রিপোর্টে লেখা ছিল, ওই কর্মকর্তা ‘প্রথমে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত’, ‘মাদ্রাসা লাইনে পড়াশোনা করেছেন’, ‘বাবরের স্পেশাল ব্যাচ’। প্রতিবেদনে তথ্য সংগ্রহের সোর্স উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে। ওই ইন্সপেক্টর ডিএমপিতে আর ওসি হতে পারেননি।
আরও পড়ুন
পিরোজপুরে জন্ম ডিবি পশ্চিম শাখার আরও এক ইন্সপেক্টরের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ইন্সপেক্টরের চাচাতো ভাই পিরোজপুরের একটি ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাই তাকে ‘বিএনপিপন্থি’ উল্লেখ করা হয়েছে। এই ইন্সপেক্টরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের কাছ থেকে।
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগে কর্মরত একজন ইন্সপেক্টরের বিষয়ে প্রতিবেদনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহিরের ‘ঘনিষ্ঠজন’ ও ছাত্রদলের নেতা বুস্টার মানিকের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা রয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তাকে ‘বিএনপিপন্থি ও বাবরের স্পেশাল ব্যাচ’ উল্লেখ করে বাদ দেওয়া হয় সম্ভাব্য ওসির তালিকা থেকে।
সিরাজগঞ্জে বাড়ি ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের এক ইন্সপেক্টরকে স্থানীয় এক কাউন্সিলরের বরাতে ‘বিএনপিপন্থি’ উল্লেখ করা হলেও তার পরিবারের কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি আইএডি।
এভাবে অসংখ্য ইন্সপেক্টরকে চাচাতো ভাই বা মামার মতো আত্মীয় এবং বিএনপি নেতাদের ‘ঘনিষ্ঠজন’ উল্লেখ করে বিএনপির ট্যাগ দেওয়া হয়েছে।
ইন্সপেক্টররা জানান, ওসি নিয়োগে বাস্তবসম্মত নীতিমালা না থাকায় তাদের অনেকে যোগ্য হয়েও ওসি হতে পারছেন না। এছাড়া যেসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তথ্য নেওয়া হয়েছে তারা সবাই বিরোধী রাজনীতির মতাদর্শী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ ছিল। এ ধরনের কাজ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। তারা সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করেনি। তারা কোনো পার্টির লোক (আওয়ামী লীগ) হিসেবে কাজ করেছে। যারা দায়িত্বে ছিল তারা মনে করেছে তারাই সব, তারাই রাষ্ট্র। তারা যে নিরপেক্ষভাবে আইন অনুযায়ী কাজ করবে এই বোধ তাদের মধ্যে জাগেনি। এ কারণেই তাদের (পুলিশের) এই পরিণতি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশের কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যবস্থা দেখতে হলে ওসি ও এসপিদের নিয়োগ নিরপেক্ষ হতে হবে। তাদের কর্মদক্ষতা, সততা, কর্মনিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে পদায়ন প্রয়োজন। যারা দলীয় বিবেচনায় এসব পদে নিয়োগ পেয়েছেন তারা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছেন। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ হলে এই জায়গাটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
ঢাকার থানাগুলোতে ছিল আওয়ামীপন্থী ওসিদের একক আধিপত্য
২০১৩ সাল থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওসি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে। অনেক আওয়ামীপন্থী প্রভাবশালী কর্মকর্তা একাধিক থানায় ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার পরিবর্তে রাজনৈতিক সংযোগের প্রাধান্য নির্দেশ করে। তাদের মধ্যে ইন্সপেক্টর আবুল হোসেন অন্যতম। আবুল হোসেন ২০১৩ সাল থেকে কোতোয়ালী, যাত্রাবাড়ী, গুলশান ও রমনা থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আওয়ামী সরকারের আমলে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ভাটারা, গুলশান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, সূত্রাপুর ও কদমতলীতে ওসির দায়িত্ব পালন করেছেন।
আরেক ওসি রফিকুল ইসলাম গত ১০ বছরে বাড্ডা, গুলশান ও বংশাল থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, অনেক যোগ্য কর্মকর্তাই রাজনৈতিক কারণে ওসির পদ থেকে বাদ পড়েছেন।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বিএম ফরমান আলীও ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিত বদলির মধ্য দিয়ে মতিঝিল, বনানী, বিমানবন্দর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢাকার থানাগুলোতে আওয়ামীপন্থী ওসিদের এই দাপটের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিএমপিতে আগে কীভাবে ওসি নিয়োগ করা হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। সে বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল নই। বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অফিসারের সততা, দক্ষতা, কাজের মান বিবেচনা করে ওসির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ওসির দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতাটাই এখানে মুখ্য বিষয়।
এআর/এসএসএইচ/এনএফ
