ভ্যাকসিন পেতে ‘ভারতের বন্ধুত্বে আস্থা’ রাখছে বাংলাদেশ
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আগামী কয়েক মাস অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত সরকার। ফলে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোর বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
তবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে সরকার এখনও নিরাশ নয়’ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘ভারতের বন্ধুত্বে আমাদের আস্থা আছে, ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। আমরা নিরাশ হচ্ছি না, চুক্তির ব্যাপারে তারা অনার করবে (সম্মান জানাবে)। আজকের মধ্যে যে কথা হয়েছে, তা পজিটিভ হিসেবে দেখছি। আলোচনার কারণে আমরা আশ্বস্ত হচ্ছি, নিরাশ হচ্ছি না।’
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আগামী কয়েক মাস অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত সরকার। ফলে বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোর বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
সোমবার (০৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। তবে কবে নাগাদ ভ্যাকসিন আসবে তা এ মুহূর্তে জানাতে পারেননি জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্রিফিং শেষে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেন, ‘হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমি এখন যে ফোনটা করলাম, ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে… তিনি আমাকে জানিয়েছেন, আমরা যে চুক্তি করেছি এটার অর্থনৈতিক যে লেনদেন, অর্থাৎ কীভাবে টাকাটা যাবে… যেহেতু কাজটি জিটুজি। অর্থাৎ সরকার টু সরকার। কিন্তু ভারত সরকার যে বিষয়টি বলেছে, কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটিজের (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) ওপর নিষেধাজ্ঞা হয়েছে। আমাদের গুলোতে না। কারণ এটি সরকার টু সরকার।
ভারতের বন্ধুত্বে আমাদের আস্থা আছে, ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। আমরা নিরাশ হচ্ছি না, চুক্তির ব্যাপারে তারা অনার করবে (সম্মান জানাবে)। আজকের মধ্যে যে কথা হয়েছে, তা পজিটিভ হিসেবে দেখছি। আলোচনার কারণে আমরা আশ্বস্ত হচ্ছি, নিরাশ হচ্ছি না
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক
সচিব বলেন, ‘যখন আমরা চুক্তিটি করি, ভারতের হাই কমিশনার নিজেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের বিষয়টি হচ্ছে জিটুজি। আর যেটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা হলো, তাদের ইন্টারনাল কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটিজ (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম) হবে না। এটি এখন হাই কমিশন থেকে ক্লিয়ার (পরিষ্কার) করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো, এতদিন ধরে নিজ দেশের সরকারের কোনো অনুমোদন পায়নি সেরাম ইনস্টিটিউট, গতকালই তারা পেয়েছে। এখন তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আবেদন করবে। এরপর তিন সপ্তাহের মধ্যে পাবে।’
সচিব বলেন, ‘যদি তিন সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন নিয়ে আসতে পারে তাহলে বলা চলে, আমরা ফেব্রুয়ারিতে পাব (ভ্যাকসিন)। তাই ডিলে (দেরি) হওয়ার কোনো অবকাশ নাই। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার মতো এখনও তেমন কিছু আমাদের হয়নি বলে আমি মনে করছি এবং স্যারও (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) মনে করছেন।’
ভ্যাকসিনের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আজকেই সকল ফর্মালেটি (আনুষ্ঠানিকতা) শেষ করেছি। আজই ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে (অর্থ পরিশোধ)।’
এর আগে ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা এ বিষয় নিয়ে সকাল থেকেই কাজ করছি। পুরোপুরি খবর আমরা এখনও অবহিত নই। ইতোমধ্যে বেক্সিমকোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার ভারতে যে আমাদের মিশন আছে, তাদের সাথে আলাপ করেছে এবং আমাদের মিশন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে। উনারা আশ্বস্ত করেছেন, আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি ব্যাহত হবে না।’
যখন আমরা চুক্তিটি করি, ভারতের হাই কমিশনার নিজেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের বিষয়টি হচ্ছে জিটুজি। আর যেটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা হলো, তাদের ইন্টারনাল কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটিজ (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম) হবে না। এটি এখন হাই কমিশন থেকে ক্লিয়ার (পরিষ্কার) করা হয়েছে
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে এতগুলো জায়গায় আলোচনা করেছি। আমরা আশ্বস্ত যে, এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আশা করি সমাধান পেয়ে যাব। এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এদিকে, ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ভারতের ভ্যাকসিন রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ঢাকা পোস্টের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এখন কিছুই বলতে পারব না। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে ভ্যাকসিন পেতে আমরা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।’
ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা
কয়েক মাসের জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রপ্তানিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা এমন তথ্য জানান।
এ বিষয়ে আমি এখন কিছুই বলতে পারব না। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে ভ্যাকসিন পেতে আমরা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করব। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন
তিনি বলেন, রোববার ভারতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তাদের ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে যে, ভারতের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে না। আমরা এ মুহূর্তে শুধু ভারত সরকারকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারব। ভ্যাকসিন মজুত না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুনাওয়ালা আরও বলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভ্যাকসিন বিক্রি করা থেকেও সেরামকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ১০০ কোটির বেশি ডোজ উৎপাদন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরবরাহের জন্য অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং গেটস ফাউন্ডেশন ও গ্যাভির সঙ্গে অংশীদারিত্ব চুক্তি রয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউটের।
ভারতের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে না। আমরা এ মুহূর্তে শুধু ভারত সরকারকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারব। ভ্যাকসিন মজুত না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে
সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা
বাংলাদেশ আগামী মাসের শুরুতে যে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে সেটি এই সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকেই পাওয়ার কথা। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ হিসাবে পুরো তিন কোটি টিকা কেনার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছিলেন, প্রতি ডোজ টিকার ক্রয়মূল্য চার ডলার। সব খরচ মিলিয়ে দাম পড়বে পাঁচ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে ৪২৫ টাকার মতো।
তড়িঘড়ি টিকার অনুমোদনে ভারতে বিতর্ক তুঙ্গে
দুটি ভ্যাকসিন জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার পর ভারতে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ভারত বায়োটেকের করোনা ভ্যাকসিন কোভ্যাক্সিনের তৃতীয় ধাপের চলমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ না হওয়ায় অনেক স্বাস্থ্য বিশেষ এই ভ্যাকসিনের অনুমোদনের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখলেও দেশটির স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) সমালোচকদের ‘একেবারে ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছে।
সমালোচনা উড়িয়ে ডিসিজিআইয়ের প্রধান ভি. জে সোমানি বলেন, কোনও ভ্যাকসিনের সুরক্ষা নিয়ে সামান্যতম উদ্বেগ থাকলে আমরা কখনই সেটির অনুমোদন দেব না। ভ্যাকসিনগুলো ১১০ শতাংশ নিরাপদ। যেকোনো ভ্যাকসিন নেয়ার পর মৃদু জ্বর, ব্যথা এবং অ্যালার্জির মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একেবারে সাধারণ ঘটনা। ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ব্যাপারে যে গুজব ছড়িয়েছে তা ভিত্তিহীন।
এই ভ্যাকসিন নেয়ার পর মানুষের শরীরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ঘাড়ে হালকা ব্যথা, মৃদু জ্বর ও সামান্য অ্যালার্জি হতে পারে বলে জানান।
সব দেশ টিকা পাবে?
১৭২টি দেশের একটি জোট (যুক্তরাষ্ট্র এ জোটে নেই) কোভ্যাক্স। সব দেশের সব নাগরিকের কাছে দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতহীন উপায়ে ভ্যাকসিন পৌঁছানোর নিশ্চয়তা চায় এ জোট। প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ব্যাধি থেকে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের জীবনরক্ষায় টিকা প্রদানে ভূমিকা রেখে আসা আন্তর্জাতিক জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহ-নেতৃত্বে কোভ্যাক্স ৯টি ফার্মাসিউটিক্যাল ডেভেলপারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভ্যাকসিনগুলো অনুমোদন পেলেই তা সংগ্রহ করা হবে।
ভ্যাকসিনের ২০০ কোটি ডোজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্স ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে চায়। কিন্তু কোনো ভ্যাকসিনের যদি একটি ডোজেও কাজ হয় (এখনও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর দুটি ডোজ প্রয়োজন হয়) তবেও ২০০ কোটি ডোজ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। আর যদিও এমন আশা আছে যে ভারতের মতো দেশগুলোতে উৎপাদকরা স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে, তারপরও বৈশ্বিক যোগান চাহিদার চেয়ে কমই থেকে যাবে। এরপরও আপাতত ভারত টিকা রপ্তানি করতে পারবে না বলে যে সিদ্ধান্ত জানা গেল তাতে পরিস্থিতি কার্যত আরও জটিল হচ্ছে।
এসএইচআর/এমএআর