আওয়ামীপন্থিদের দাপটে ‘বিপর্যস্ত’ মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। অথচ এখনও শেষ হয়নি আওয়ামী শাসনামলে সুবিধাভোগীদের দাপট। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানে খোলস বদলে নতুন আধিপত্যের জাল বিস্তার করছেন তারা। কেউ কেউ নাম লেখাচ্ছেন বঞ্চিতদের তালিকায়। সুশীলদের ব্যানারে কেউ আবার গড়ে তুলছেন নতুন সিন্ডিকেট।
এমনই সুবিধাভোগীদের খপ্পরে পড়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ফলে একদিকে যেমন চিকিৎসকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অন্তঃকলহ, অন্যদিকে ভোগান্তি বাড়ছে সেবাপ্রত্যাশীদের। দেশে নতুন সরকারের মেয়াদ দুই মাসের বেশি হলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল চলছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীদের প্রেসক্রিপশনে।
শক্তিশালী সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি চিকিৎসক হয়েও আওয়ামী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অর্গানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম সুমন, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। এ সিন্ডিকেটের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। তিনি ও হেলাল আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের অঘোষিত নির্বাচনী ক্যাম্প।
সরকারি চিকিৎসক হয়েও আওয়ামী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অর্গানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম সুমন, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। এ সিন্ডিকেটের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ডা. অভ্র দাস ভৌমিক। তিনি ও হেলাল আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের অঘোষিত নির্বাচনী ক্যাম্প
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের ব্যানারে নৌকার পক্ষে একাধিক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও ডা. তারিকুল আলম সুমনসহ এ সিন্ডিকেটের চিকিৎসকরা। এসব মতবিনিময় সভায় অতিথি করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও শেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রিসভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানাকে। মতবিনিময় সভায় এ সিন্ডিকেটের সব চিকিৎসকই নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালান; যা সরকারি চাকরি বিধিবহির্ভূত। এ হাসপাতালে স্বাচিপের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ডা. অভ্র দাস ভৌমিক, সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. তারিকুল আলম সুমন।
আরও পড়ুন
নৌকার প্রচারণায় অংশ না নিলে ‘বঞ্চনা’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই সিন্ডিকেট চিকিৎসকদের হাতে হাসপাতালটির সিনিয়র স্টাফ নার্স, ওয়ার্ড বয়, আউটসোর্সিং কর্মচারীসহ সবাই জিম্মি ছিলেন। তাদের ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ না নিলে আসত হুমকি ও বঞ্চনা। ২০০৭ সাল থেকে হাসপাতালে দায়িত্বপালন করা নার্সিং সুপারভাইজার ফিরোজা আক্তারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, যেসব নার্স এসব চিকিৎসকের কথা শুনে এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন, কেবল তারাই পদোন্নতি পেতেন। যারা তাদের কথা শুনতেন না, তারা হতেন বঞ্চিত। নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতে সবাইকে অংশ নিতে বাধ্য করা হতো। কখনও হাসপাতালে, কখনও হাসপাতালের বাইরে তারা এসব কর্মকাণ্ড চালাত।
অপর সিনিয়র স্টাফ নার্স নমিতা হালদার বলেন, আমাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি মেইনটেইন করা হয়। কিন্তু আমি এবং আমার অন্য এক সহকর্মীকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়। আমি পদন্নোতির তালিকায় ৭ নম্বরে থেকেও বঞ্চিত হই। আমাকে বাদ দিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয় তালিকায় ২৫ নম্বরে থাকা জাকিয়া সুলতানা নামের এক সিনিয়র স্টাফ নার্সকে। তার স্বামী পুলিশের চাকরি করেন।
‘ডা. তারিকুল আলম সুমন, ডা. হেলাল আহমেদরা এখনও তাদের দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন। এখনও তারা প্রতিষ্ঠানটি দখল করে রেখেছেন।’
নমিতা হালদার বলেন, ‘বর্তমানে যিনি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট, তার বাসা গোপালগঞ্জে। তাকে দিয়েই সব অনিয়ম হয়। স্বাচিপের সব চিকিৎসক এখনও হাসপাতাল দখল করে রেখেছেন। ডা. তারিকুল আলম সুমন ও ডা. হেলাল আহমেদরা আওয়ামী লীগকে নিয়ে যেসব মতবিনিময় সভা করতেন, সেসব সভায় আমাদের যেতেই হতো। না গেলে কখন কী সমস্যা হয়, এই ভয়ে আমরা যেতাম। এখনও তারা হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রশিক্ষণ দেবেন না, আবার বদলি করার ভয় দেখিয়ে তাদের দলে ভেড়াতে বাধ্য করছেন। এখানে প্রতিনিয়ত মানসিক হয়রানি চলছে।’
আরও পড়ুন
শুধু ফিরোজা আক্তার কিংবা নমিতা হালদারই নন; এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
শান্তি মিছিলের নেতৃত্বে ছিল হেলাল সিন্ডিকেট
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ডা. হেলাল আহমেদ এবং এই সিন্ডিকেটের চিকিৎসকেরা। ঢাকা পোস্টের হাতে আসা বিভিন্ন তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, গত ৩ আগস্ট শান্তি মিছিলের নামে ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিরোধে সরাসরি অংশ নেন ডা. হেলাল আহমেদ ও তার সহযোগীরা।
আওয়ামী লীগের পতন : কেক কেটে বিপাকে তুহিন মিয়া
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে কেক কেটে একটি আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেন সাধারণ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন আউটসোর্সিং কর্মচারী মো. তুহিন মিয়া। এর কিছুদিন পর চাকরিতে অনিয়মিত করা হয় তাকে।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হলে তুহিন মিয়া বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে আমি কাজ করছি। আমাকে মাত্র আট হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। অথচ আমাদের মূল বেতন ১৭ হাজার ৬১০ টাকা। সহকারী বাবুর্চি হিসেবে আমি এতদিন কাজ করেছি। গত ৫ আগস্ট সরকারপ্রধান পালিয়ে যাওয়ার পরের দিন আমাদের হাসপাতালে কেক কেটে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই কেক কাটা অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। এর কয়েকদিন পর আমাকে আর ডিউটি দেওয়া হয়নি। ওয়ার্ড মাস্টার মিরাজ আমাকে বলেন, আগামীকাল থেকে তোমার আর ডিউটি নেই। তিনি ডা. তারিকুল আলম সুমনের আত্মীয়। আমি এখন বেকার হয়ে ঘুরছি। ওই কেক কাটতে যাওয়াতে আমার এই অবস্থা।’
আউটসোর্সিংয়ের টাকা যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির আউটসোর্সিং খাতে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। জানা যায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে আদিল কর্পোরেশন ও ধলেশ্বরী এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান জনবল সরবরাহ করছে। প্রায় ৭৮ জন কর্মচারী সরবরাহ করা দুটি প্রতিষ্ঠানই এ খাতে কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছে। শ্রম আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হচ্ছে না কর্মচারীদের পুরো বেতন। আউটসোর্সিং খাতের এ অনিয়মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. তারিকুল ইসলাম সুমনের আত্মীয় অফিস সহায়ক মিরাজ।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে আউটসোর্সিং কর্মচারী তাপস কান্তি বেপারীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, ‘আমাদের বেতন নির্ধারণ করা আছে ১৭ হাজার ৬১০ টাকা। কিন্তু দেওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা কোথায় যায় আমরা বলতে পারি না। ঠিকাদারদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, এটা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে দেওয়া লাগে। আবার অফিস থেকে বলা হয়, এটা ঠিকাদাররা জানেন। কোম্পানির কাছে জিজ্ঞাসা করলে বলে, অফিসের নানা খরচ আছে, সেখানে ব্যয় হয়।’
‘আউটসোর্সিং মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কেউ কেউ আট হাজার টাকা পান, কেউ আবার ১০ হাজার; ১৫ হাজারও পান কেউ কেউ’— যোগ করেন তিনি।
কাজল রানী নামে এক কর্মচারী অভিযোগ করেন, ‘ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ধলেশ্বরীকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে চাকরি নিই। বেতন পাচ্ছি মাত্র আট হাজার টাকা। যারা কম টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন, তাদের বেতন আরও কম। যারা দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন, তারা বেতন পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। আর যারা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন, তাদের দেওয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। অথচ আমি ৫০ হাজার টাকা দিয়েও বেতন পাচ্ছি আট হাজার টাকা।’ বেতন ব্যাংকে না হতে দেওয়া হয়— জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, হাতে দেওয়া হয়।
আউটসোর্সিং কর্মচারী রমজান বলেন, ‘আমাদের কিছু টাকা কম দেওয়া হয়। যে টাকা কেটে রাখা হয় সেটা কী জন্য কাটা হয়, আমরা জানি না।’
মো. মহিউদ্দিন নামে অপর কর্মচারী বলেন, নিয়োগের সময় আমাদের কারও কারও কাছ থেকে ৫০ হাজার, দুই লাখ, আড়াই লাখ, এমনকি দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। তবে, সবাইকে নির্ধারিত বেতনের কম অর্থ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আদিল কর্পোরেশনের মালিক আপন মিয়া বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। আমরা সবাইকে পরিপূর্ণ বেতন দিই। এ ছাড়া নিয়োগ দেওয়ার নামে মোটা অঙ্কের ঘুষের অভিযোগও মিথ্যা। এদিকে, ধলেশ্বরী এন্টারপ্রাইজের মালিক আতিকুল ইসলামকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।
বেতন বৈষম্য নিয়ে কর্মচারীদের লিখিত অভিযোগ
আউটসোর্সিং খাতে চলমান বেতন বৈষম্য নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী কর্মচারীরা। পৃথক পৃথক এসব অভিযোগে তারা এ খাতের নিয়োগ বাণিজ্য, বেতন বৈষম্য, ওভার টাইম প্রদান না করা, ছুটি না দেওয়া, নির্ধারিত সময়ে বেতন না দেওয়া, চেকবইতে সই নিয়ে তা আটকে রাখাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। পরিপূর্ণ বেতন চাইলে চাকরি থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন তারা।
সাপ্লাই থাকার পরও লেখা হয় ভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা একাধিক প্রেসক্রিপশন বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসেনশিয়াল ড্রাগস ইন্টারন্যাশনালের সরকারি ওষুধের সরবরাহ থাকার পরও বেসরকারি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখা হয়। একাধিক প্রেসক্রিপশন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেসরকারি একই ব্র্যান্ডের ওষুধের নাম বারবার লেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ফার্মাসিস্ট মো. আরিফুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় টেন্ডার করে মানসিক সমস্যার জন্য প্রয়োজন এমন ওষুধ কিনি। এসব ওষুধ রোগীরা ফ্রি পান। কিন্তু আউটডোরে যেসব ডাক্তার রোগী দেখেন তাদের অনেকেই সাপ্লাই থাকা ওষুধের নাম না লিখে ভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ লেখেন। এতে ওষুধ সাপ্লাই থাকার পরও অনেকের বাইরে থেকে কিনতে হয়। আমাদের কাছে যেসব ওষুধের সাপ্লাই আছে সেসব ওষুধের তালিকা ডাক্তারদের দেই। তারপরও বেসরকারি ভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধ কেন লেখেন, সেটা তারা ভালো জানেন।
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, আমরা অনেক ওষুধ লিখতে বাধ্য হই। উপর থেকে বলা হয় এই এই ব্র্যান্ডের ওষুধ লিখবেন। আমাদের কিছুই করার থাকে না। বাধ্য হয়েই লিখি। এতে আমাদের তো লাভ নেই। লাভ যা হওয়ার বা যদি হয় সেটি উপর থেকেই হয়।
খুঁড়িয়ে চলছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের জন্য চালু হওয়া ওয়ার্ড
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে শহীদদের আত্মীয়-স্বজন ও আহত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফ্রি মানসিক সেবা কার্যক্রম চালু করতে উদ্যোগ নেন হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. শফিকুল কবির জুয়েল। কিন্তু এ ওয়ার্ড চালু করার সময় তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন বলেও অভিযোগ করা হয়। পরবর্তীতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর এ ওয়ার্ড চালু হয়। বিশেষ এ ওয়ার্ডে রোগীদের বিভিন্ন থেরাপি ও চিকিৎসা চলছে। তবে, ওয়ার্ডটিতে পর্যাপ্ত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেন রোগীরা।
এ ওয়ার্ডেই চিকিৎসা নিচ্ছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক কমল চন্দ্র দাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন তিনি একটি ডকুমেন্টরি তৈরি করতে বের হন। কিন্তু চিত্রগ্রহণের সময় রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ দেখে সাময়িক মানসিক বিকারগ্রস্ত হন তিনি। এরপর থেকেই চিকিৎসা শুরু হয় কমলের। প্রথমে গুলশানের বিকন পয়েন্টে চিকিৎসা নিলেও পরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় কমল চন্দ্র দাসের মা কল্পনা রানী দাসের। এ হাসপাতালে সুষ্ঠু চিকিৎসা পাচ্ছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে কী চিকিৎসা দিচ্ছে, বুঝতেছি না। আমি গত ১৫ দিন আসছি এখানে, কিন্তু আমার ছেলের কোনো পরিবর্তন দেখছি না। যে পাগল নিয়ে আসছি সেই পাগলই দেখতেছি। ডাক্তারদের পাঁচতলা, ছয়তলায় খুঁজে দেখা পেতে হয়। যেসব ইনজেকশন তারা লেখেন, সেগুলোর বিষয়ে কিছু না বুঝলেও নার্সরা সহযোগিতা করেন না।’
এমন অভিযোগ শুধু কমল চন্দ্র দাসের মা কল্পনা রানীর নয়। সরেজমিনে ঘুরে এবং একাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটি উপপরিচালক ডা. শফিকুল কবির জুয়েল বলেন, ওয়ার্ডটি চালুর সময়ই আমি বাধাপ্রাপ্ত হই। যারা শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা তো নিশ্চয় এ আন্দোলনে অসুস্থ হওয়া শিক্ষার্থী বা তাদের পরিবারের জন্য কাজ করবেন না। সংগত কারণেই তারা এখন বাধা দিচ্ছেন। সর্বশেষ এ ওয়ার্ড চালু হলেও পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স সরবরাহ করা হয় না। সবসময় ওয়ার্ড বয়ও রাখা হয় না। অথচ আমি চেয়েছিলাম ওয়ার্ডটিতে বিশেষভাবে সেবা দেওয়া হবে। সেবা না দেওয়ার অন্যতম কারণ, ওয়ার্ডটি আমার উদ্যোগে চালু! আশা করছি, আওয়ামী লীগের দলীয় চিকিৎসকদের মুক্ত করতে পারলেই এ হাসপাতাল চিকিৎসাসেবার একটি মডেল হবে।
অসহযোগিতার অভিযোগ চিকিৎসকদেরও
এ বিষয়ে অ্যাডিকশন সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. সাইফুন্নাহারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের জন্য যে ওয়ার্ড চালু হয়েছে সেখানে আমারও একটি রোগী রয়েছে। সেই রোগীর পরিবারও যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। এখানে প্রধানত অসহযোগিতার সমস্যাটা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ওয়ার্ডে যেসব জুনিয়র ডাক্তার দায়িত্বে থাকেন তারা অধিকাংশ সময় রোগীর সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসককে অবহিত করেন না। ফলে সেবাদানের চেইনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
“এ ছাড়া আমি টেলিসাইকিয়াট্রি বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ বিভাগে আগে যেভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেছে এখন সেটি বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তাররা সিনিয়র ডাক্তারদের কল করে রেসপন্স না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে একাধিকবার কল করেও পাচ্ছি না’। পরে বাধ্য হয়ে আমি নিজে সেই ডাক্তারকে কল করে জানিয়েছি বিষয়টি। আমি ফোন করার অনেকক্ষণ পর তিনি রেসপন্স করেন। এমন ঘটনা প্রায়ই হচ্ছে। কার কোনদিন ডিউটি, সেই রোস্টার থাকার পরও আমাকে কেন ফোন করা লাগবে? আসলে এখানেও কো-অপারেশনের বড় একটা ঘাটতি দেখছি। যারা এখানে অসহযোগিতা করছেন তারা সবাই চিহ্নিত।”
সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে ওএসডি হন কবির জুয়েল
সরেজমিনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন এ হাসপাতালে চলতে থাকা অনিয়ম, ইনস্টিটিউটকে রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার, আউটসোর্সিং খাতে অনিয়ম এবং এএসপি আনিসুল করিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চক্রের বিচারের জন্য মানববন্ধন করার ফলে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হন হাসপাতালের উপপরিচালক সফিকুল কবির জুয়েল।
ওএসডির পর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর করা ওই আবেদনে বলা হয়, এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক সদ্য পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী এবং কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি ও তার সহযোগী চিকিৎসকগণ বিগত ১৬ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক অনিয়মসহ ভয়ানক দুর্নীতি ও বৈষম্য তৈরি করেন। বিগত ৫ আগস্ট সরকারপ্রধান পালিয়ে যাওয়ার পর ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে উপ-পরিচালক হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া তাদের নির্লজ্জকর দুর্নীতিসমূহ তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই তারা ফ্যাসিবাদ চক্রকে ব্যবহার করে ডা. মোহাম্মদ সফিকুল কবিরকে অন্যায়ভাবে গত ১ সেপ্টেম্বর ওএসডি করান। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা যিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন পরিচালক ছিলেন, তার সহায়তায় এটি সম্ভব হয়েছে। কারণ, সচিবালয়ে তার ফাইলে ওএসডির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ নেই।
আরও পড়ুন
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন ডা. সফিকুল কবির জুয়েল। ওই আবেদনে তিনি তার ওএসডির বিষয়ে ব্যাখ্যা চান। একইসঙ্গে ওএসডি সম্পর্কে তিনি সচিব বরাবর লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন।
এএসপি আনিসুল করিম হত্যা : অভিযোগের তির তারিকুল আলম সুমনের দিকে
পুলিশের ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা আনিসুল করিম হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত চেয়ে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই তদন্ত আবেদনে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ডা. তারিকুল আলম সুমনের জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে ডা. সফিকুল কবির জুয়েল বলেন, তারিকুল আলম সুমন মাইন্ড এইড হাসপাতালের একজন বিনিয়োগকারী ছিলেন। ওই হাসপাতালে যে সরকারি চিকিৎসকদের বিনিয়োগ ছিল, এটা নিয়েও জাতীয় দৈনিকগুলোতে অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তারিকুল আলম সুমনই সরকারি হাসপাতাল থেকে তার নিজের বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান মাইন্ড এইড হাসপাতালে আনিসুল করিমকে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে ওই হাসপাতালেই আনিসুল করিম শিপন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এটা নিয়ে ওই জোনের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন কর্মকর্তা ও সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদও ডিবিসিতে তারিকুল আলম সুমনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ডিবিসির ওই ভিডিও কন্টেন্ট অজানা কারণে সরিয়ে ফেলা হয়। আমরা চাই ওই ভিডিও প্রতিবেদন উদ্ধার করে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তারিকুল আলম সুমনের বিচার করা হোক।
বিতর্কিত চিকিৎসকদের বদলি ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন
গত ৫ আগস্টের পর থেকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে একাধিক মানববন্ধন করা হয়। এসব মানববন্ধনে হাসপাতালটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আওয়ামী সরকারের এজেন্ট চিকিৎসকদের শাস্তির দাবি জানান। আওয়ামীপন্থি এসব চিকিৎসকের অপকর্মের নানা ছবি দিয়ে ব্যানার টানিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জেরিয়াট্রিক অ্যান্ড অর্গানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডা. মোহাম্মদ তারিকুল আলম সুমন বলেন, ‘তারা যেসব অভিযোগ এনেছেন, সেগুলো মিথ্যা। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, কিন্তু সবাইকে জোর করে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। আমাদের হাসপাতালে এ ধরনের পরিবেশ ছিল না।
তিনি বলেন, আউটসোর্সিং খাতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত যে মিরাজের কথা বলছেন সে আমার আত্মীয়। তার বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা তদন্ত করে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হোক, এটা আমারও দাবি।
এ বিষয়ে চাইল্ড অ্যাডলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে মন্ত্রণালয় বিধিমোতাবেক দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. অভ্র দাস ভৌমিক বলেন, আমি কখনও কাউকে জোর করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সভায় আসতে বাধ্য করিনি। আমি পরিচালক থাকা অবস্থায় জাহাঙ্গীর কবির নানক একবার মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে বলেন। ওই সময় আমাদের কনফারেন্স রুমে আমরা একটা মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। আমি ওই ইনস্টিটিউটের স্বাচিপের সভাপতি হয়েও কোনো ডাক্তারকে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে যেতে বলিনি, আমি নিজেও যাইনি। এমনও হয়েছে, আওয়ামী শাসনামলে অনেক ভিন্ন মতাদর্শের ডাক্তারদের পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করেছি।
টিআই/এমএম/