নথি চুরির মামলায় ‘চুরি হওয়া’ নথির তথ্য নেই
‘প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের কাছে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে টিকা সংক্রান্ত নন-ডিসক্লোজার চুক্তির কাগজ ছিল। এগুলো প্রকাশ করলে দেশের বিরাট ক্ষতি হতো’— রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতারের পর এমন মন্তব্য করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তবে শাহবাগ থানা পুলিশ বলছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তারা এ ধরনের কোনো কাগজ পাননি। জব্দ তালিকায় ‘নন-ডিসক্লোজার’ চুক্তির কোনো কাগজের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
বুধবার (১৯ মে) রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির তদন্তের ভার দেওয়া হয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে। পাশাপাশি শাহবাগ থানা থেকে ডিবিকে মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেই নথিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- রোজিনা ইসলামের কাছ থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রের জব্দ তালিকা।
আরও পড়ুন: অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, রোজিনা ইসলাম ও আইনি পর্যবেক্ষণ
জব্দ তালিকায় যা আছে
জব্দ তালিকার মধ্যে ছিল জেনেভা মিশনে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের দুই পাতার একটি চাহিদাপত্র (ডিও লেটার), করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যবহৃত চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ের ৫৬ পাতার একটি পত্র। পত্রটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। একই চিঠির দুই পাতার সার সংক্ষেপ রয়েছে জব্দ তালিকায়।
এছাড়া জব্দ তালিকায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটির অনুমোদন সংক্রান্ত দুই পাতার সার সংক্ষেপের ফটোকপি ছিল। ছিল একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি ফোন, একটি আইফোন ও দুটি পিআইডির অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বলেছিলেন
সচিবালয়ে রোজিনা ইসলামকে আটকে রাখা, পরবর্তীতে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘রোজিনা ইসলাম করোনাভাইরাসের টিকা সম্পর্কে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্প্রতি স্বাক্ষর হওয়া চুক্তিবিষয়ক নথিপত্র নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যে ফাইলগুলো তিনি নিয়েছেন, সেগুলো ছিল টিকা (করোনাভাইরাসের টিকা) সংক্রান্ত। এগুলো গোপন নথি। আমরা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যে টিকা চুক্তি করছি, এগুলো নন-ডিসক্লোজার চুক্তি। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বলেছি যে, আমরা এটা গোপন রাখব।’
তিনি আরও বলেছিলেন, গোপন নথি যদি বাইরে চলে যায় তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলাম এবং আমাদের তারা টিকা নাও দিতে পারে। এতে দেশের বিরাট ক্ষতি হতে পারে।
তবে শাহবাগ থানা পুলিশ বা ডিবি কারো কাছেই রাশিয়া কিংবা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিপত্রের কোনো কপি নেই।
তদন্ত নিয়ে ডিবি যা বলছে
বুধবার মামলাটির তদন্তের ভার পায় ডিবি। ডিবির রমনা জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা মামলাটির তদন্ত করছি। আমরা মূলত যেকোনো মামলার ফ্যাক্ট অ্যান্ড ইস্যু নিয়ে তদন্ত করি। এজাহার হচ্ছে ফ্যাক্ট অ্যান্ড ইস্যু। ওখানে যে বিষয়গুলো দেওয়া আছে, সেটির সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার প্রমাণ পেলে মামলাটি প্রুভ করার অথবা প্রমাণ না থাকলে ডিবি তথ্যগুলো ডিসপ্রুভ করার চেষ্টা করবে। সত্য ঘটনা হলে প্রমাণিত হবে, সত্য না হলে অপ্রমাণিত হবে। তদন্ত নিরপেক্ষ হবে, কারো পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই।’
আইনজীবীরা যা বলছেন
দেশের প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণ সমীচীন হয়নি। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, দেখতে হবে সেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। আসলে এটা তো প্রিম্যাচিউর (অকালপক্ব) আইডিয়া। আমি মনে করি, তার (রোজিনা ইসলাম) বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নাই। কোনো তথ্য সে ফাঁস করেনি। তথ্য আহরণের চেষ্টা করেছে মাত্র।’
‘এ ধরনের আইন দ্বারা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াটা সঠিক হয়নি। যে অপরাধটা সংঘটিত হয়নি সেই অপরাধে তাকে আসামি করা সঙ্গত বলে আমি মনে করি না। সে হয়ত তথ্য আহরণের চেষ্টা করেছে। এটা সাংবাদিকরা করতেই পারে। তথ্য আহরণ সাংবাদিকদের অধিকার। অফিসিয়াল সিক্রেসি মেইনটেইন (সরকারি গোপনীয়তা রক্ষণাবেক্ষণ) করবেন তো কর্মকর্তারা।’
ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, “ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর মতো অনেক আইন করেছিল। কারণ, তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয় ছিল। হঠাৎ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনের ব্যবহার, আমি বলব এটা আইনের অপপ্রয়োগ মাত্র। আইনগতভাবে এ আইন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নাই।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, “সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ অনুযায়ী, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করা (Guaranteed) হয়েছে। অনুচ্ছেদটি দুই ভাগে বিভক্ত। উপ-অনুচ্ছেদ ১-এ বলা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ উপ-অনুচ্ছেদ- ২ অনুযায়ী কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যথা : রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা, আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা। অর্থাৎ, সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা (Wide Term) মৌলিক অধিকার। প্রশ্ন হলো, Investigative Journalism বন্ধ হলে বা কার্যকর না থাকলে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ কি জীবিত থাকবে? উত্তর হলো, ‘না’। সেজন্য Investigative Journalism-ই অনুচ্ছেদ ৩৯ কে লাইভ (বাঁচিয়ে) রাখে। মৌলিক অধিকার জীবন্ত রাখতে হলে Investigative Journalism বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। এতে যদি কারো অসুবিধা হয় তা একান্তই ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দলের; সংবিধানের কোনো সমস্যা নেই। আইনের কোনো সমস্যা নেই।”
গত সোমবার (১৭ মে) পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। চুরির অভিযোগ এনে সেখানে তাকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৯টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় আনা হয়। রাতেই রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের হয়।
এরপর মঙ্গলবার (১৮ মে) তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ওসি, তদন্ত) আরিফুর রহমান সরদার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বৃহস্পতিবার (২০ মে) তার জামিন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক বাকী বিল্লাহ ভার্চুয়াল আদালতে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদেশের জন্য আগামী রোববার (২৩ মে) দিন ধার্য করেন।
এআর/এমএইচএস