লাখ কোটি টাকা কেলেঙ্কারির হোতা ছিলেন মাসুদ বিশ্বাস!

২০১০-২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম ও সবচেয়ে বড় অর্থ কেলেঙ্কারি। এরপর রিজার্ভ চুরি ও বিভিন্ন সময় বেসিক, জনতা, ফারমার্স এবং ইসলামী ব্যাংক কেলেঙ্কারিসহ অন্তত ২৫টি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ৯২-৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট হয়েছে।
এসব কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও গ্রুপের নাম সামনে এলেও আড়ালে ছিলেন মাস্টারমাইন্ডরা। ব্যাংকখাতে মহা-হরিলুটে নেতৃত্ব দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। যাদের কাছে জিম্মি ছিল ব্যাংকপাড়া।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, মূলত শর্ষের মধ্যে ভূত হয়ে ছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অর্থ পাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা এই সংস্থাটির সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস নিজেই অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন।
গত ১৫-১৬ বছরে দেশের আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি হয়েছে। মাসুদ সিন্ডিকেট এসব কেলেঙ্কারি পরবর্তী ধামাচাপা দিতে শ্রম দিতেন। এছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখতে কাজ করতেন
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে সুর) ও বিএফআইইউ-এর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম একই সিন্ডিকেটের। গত ১৫-১৬ বছর ধরে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫-১৬ বছরে দেশের আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি হয়েছে। মাসুদ সিন্ডিকেট এসব কেলেঙ্কারি পরবর্তী ধামাচাপা দিতে শ্রম দিতেন। এছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখতে কাজ করতেন।

অর্থ পাচার ঠেকানোর প্রধান দায়িত্ব থাকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কিন্তু ওই সংস্থা তা প্রতিরোধ করতে পারিনি। উল্টো বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন। তারই হস্তক্ষেপে সন্দেহভাজন ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়নি
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এস কে সুর ও মাসুদ বিশ্বাস একই সিন্ডিকেটের। মাসুদ বিশ্বাসকে প্রায় ২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৮ জানুয়ারি (শনিবার) মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। গত ১৫-১৬ বছর ধরে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তিনি বলেন, এই সিন্ডিকেটের প্রধান এজেন্ডা ছিল হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, এস আলম, নাসা, সিকদার ও বেক্সিমকোসহ বিভিন্ন গ্রুপের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে আর্থিকখাতে লুটপাট করা এবং পরবর্তী সময়ে খলনায়কদের সুরক্ষা দেওয়া। আর সুরক্ষার কাজটি করেছেন মাসুদ বিশ্বাস গং। ওইসব ব্যক্তিদের বুদ্ধি ও পরামার্শে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। তারাই রিজার্ভ চুরি সঙ্গে যুক্ত বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
অবৈধ সম্পদ অর্জনে অভিযোগে গত ২ জানুয়ারি মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার প্রেক্ষিতে মাসুদ বিশ্বাসকে শনিবার (১৮ জানুয়ারি) গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
দুদক সূত্র জানায়, দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এছাড়া অভিযোগ তদন্তে দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানকে দলনেতা করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এছাড়াও অভিযোগ অনুসন্ধানে সম্পদের তথ্য চেয়ে গত ৩ অক্টোবর আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ ১১ দেশে চিঠি দেওয়া হয়। যদিও চিঠির জবাব এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মাসুদ বিশ্বাস ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৬২২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে মামলা রুজু করা হয়। দুদকের অনুসন্ধানে মাসুদ বিশ্বাসের নামে ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৫ টাকার নীট সম্পদসহ মোট ৫ কোটি ৮৮ লাখ ৬০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
অপরদিকে মাসুদ বিশ্বাসের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে ৭২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৯ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদের তথ্য পায় দুদক। এরপর তার বিরুদ্ধে পৃথক সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারির অনুমোদন দেওয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এই দম্পতির নামে জমি ও ফ্ল্যাট রয়েছে জানিয়ে তা খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে দুদক।
দুদক মহাপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাসুদ বিশ্বাসকে প্রায় ২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৮ জানুয়ারি (শনিবার) মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আদালতে ৫ থেকে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হবে। রিমান্ডে তাকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অবৈধ সম্পদ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত বের করতেই রিমান্ড চাওয়া হবে।
মাসুদ বিশ্বাসের যত অপকর্ম
অর্থ পাচার ঠেকানোর প্রধান দায়িত্ব থাকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কিন্তু ওই সংস্থা তা প্রতিরোধ করতে পারিনি। উল্টো বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন। তারই হস্তক্ষেপে সন্দেহভাজন ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়নি।
তিনি ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ইভেন্ট আয়োজন ও বিদেশ সফরের মাধ্যমে অর্থ অপব্যয়ের সুযোগ করে দিতেন। গত কয়েক বছর বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বছরে গড়ে ৮-১০টির মতো বড় তদন্ত দায়সারাভাবে শেষ করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, এস আলম গ্রুপ ও আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ বিদেশে অর্থ পাচার করছে জেনেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। গ্রুপ দুটি থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন তিনি।
এছাড়া ইউসিবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে থার্মেক্স গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মঞ্জুরিকৃত ঋণের অর্থ ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তরের গুরুতর অনিয়ম বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও উৎকোচ গ্রহণ করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি। এছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের অবজারভার থাকা অবস্থায় ওই ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন মাসুদ বিশ্বাস।
আরও অভিযোগ রয়েছে, তমাল পারভেজের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ আর্থিক অনিয়মের প্রতিবেদনকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন হিসেবে না পাঠিয়ে ‘সাধারণ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ হিসেবে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছেন বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান।
দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তানাকা গ্রুপ, এসএ গ্রুপ ও আনোয়ার গ্রুপের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ‘নিশ্চিত তথ্য’ থাকা সত্ত্বেও অভিযোগগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে না পাঠিয়ে মাসুদ বিশ্বাস ‘ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে’ নথিভুক্ত করেন।

এদিকে অন্য একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, রূপালী ব্যাংকের গ্রাহক ডলি কনস্ট্রাকশনের অনুকূলে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করে ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। বিষয়টি বিএফআইইউর তদন্তে ধরা পড়লেও মাসুদ বিশ্বাস ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। পাশাপাশি ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক সান্ত্বনা এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকটির চারটি শাখা থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিতরণ করে। মাসুদ বিশ্বাস শাখা ব্যবস্থাপকদের থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
এছাড়া সাদ-মুসা গ্রুপ একাধিক ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার গৃহীত ঋণের অনিয়ম যাচাইকালে বিভিন্ন ব্যাংকের গাফিলতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম উদঘাটিত হলেও তিনি দাপ্তরিক ক্ষমতাবলে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহক সাজিদা ফাউন্ডেশনের চুয়া ডেবিট ইন্সট্রাকশনের বিপরীতে ২০২১ সালে ৮২ হাজার ৪১৬ ডলার আইএনজি ব্যাংকের গ্রাহক এফএমও এনভি আইএনএল এমএএসএসআইএফ-এর অনুকূলে পাঠানোর মাধ্যমে পাচার করে। মাসুদ বিশ্বাস ব্যাংকটির কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে অনিয়মটি ধামাচাপা দিয়েছেন।
এছাড়া যমুনা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার গ্রাহক শিরিন স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং এনআরবিসি ব্যাংকের গ্রাহক বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি টাইগার আইটির নামে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানে অনুমোদনের জন্য মাসুদ বিশ্বাস অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। এছাড়াও তিনি মার্কেট সিস্টেমস ও নগদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ গ্রহণ করেন।
আরএম/এমএসএ