যত বাধাই আসুক, পলিথিন বন্ধের কার্যক্রম চলবে

সবার স্বার্থে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, এটি করা না হলে আমরা আমাদের মাটি, নদী ও জলাশয় বাঁচাতে পারব না।
ঢাকা পোস্টের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে ব্যক্তি উদ্যোগে সচেতনতা বাড়ানোর উপরও জোর দেন রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘আপনি বাজারে গেলেন, বিক্রেতা আপনাকে পলিথিন ব্যাগ দিলেও নেবেন না। বলবেন, আমি সচেতন মানুষ। বাসা থেকেই ব্যাগ নিয়ে এসেছি। ব্যক্তি উদ্যোগের এ সচেতনতা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।’

উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আমাদের বাবাদের দেখেছি পাটের ব্যাগ, চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যেতে। বাংলাদেশে একটি তর্ক শুরু হয়ে গেছে যে, পলিথিনের বিকল্প নেই। এটি ঠিক নয়। পলিথিনের অবশ্যই বিকল্প আছে। প্রথাগতভাবে পলিথিনের বিকল্প বহুকাল আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। আমাদের বাবারা যেটা নিয়ে বাজার করতে গেছেন, সেটিই আমাদের বিকল্প। তাহলে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা যাবে।’
‘২০২৪ সালে আমরা পলিথিন বন্ধের কাজটি শুরু করলাম। আমরা যখন পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করতে যাচ্ছি, তখন কোথাও কোথাও বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। যত বাধাই আসুক না কেন আমরা থামব না।’

তিনি আরও বলেন, পলিথিন উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা মানবেতর পরিবেশে কাজ করেন। এটি নিয়ে কিন্তু সোচ্চার নয় পলিথিন কারখানার মালিকেরা। স্বার্থে আঘাত লেগেছে বলেই পলিথিন নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপের বিষয়ে সমালোচনা করছেন তারা। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না হলে দেশের পরিবেশ বাঁচানো সম্ভব হবে না। তা-ই এ বিষয়ে আমার অবস্থান পরিষ্কার।
পলিথিনে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়
পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। স্বাভাবিকভাবে পলিথিন পচনশীল নয়। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। পলিথিন মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং মাটির গুণাগুণ বিনষ্ট করে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে।
পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহারে সারাদেশে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। বর্তমানে নামিদামি কসমেটিক কোম্পানির সাবান, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট, বডিওয়াশ, ডিটারজেন্ট, বিস্কিট, চানাচুর, চিপস, মশলা ইত্যাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদির মোড়কে মাইক্রোবিড নামক ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখা যায়। যা ব্যবহারের পর নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে যাচ্ছে এবং মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। পরবর্তীতে এটি চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করছে পলিথিন
বিশ্ব ব্যাংকের করা এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের তিন প্রধান নদী— পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন পড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেও পলিথিনের অবদান কম নয়। পলিথিন উৎপাদন এবং পুনরায় প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় তা কারখানার চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।
ইউরোপের তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বেশি এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সব থেকে পিছিয়ে। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। নিত্যদিনের বাজার করতে গেলেই পলিথিনের দরকার হয়।
আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে। প্রায় সব দোকানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে পলিথিনের স্তূপের দেখা মেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও শোভা পায় পলিথিনের ব্যাগ। অথচ আইন করে সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার শহরাঞ্চলের জাতীয় গড় থেকে তিনগুণেরও বেশি, যা বর্তমানে ২২.২৫ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যা পুরো বাংলাদেশে উৎপন্ন বর্জ্যের ১০ শতাংশ। নিষিদ্ধ পলিথিনের কারণে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের।
পলিথিনের ব্যবহার যে কারণে বেশি
পলিথিনের উৎপাদন খুব সহজ হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। সহজে বহন করা যায় বলে এটিকে সবাই পছন্দ করে। এটি সংরক্ষণও খুব সহজ হওয়ায় অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। এর বিকল্প হিসেবে আমরা এখনও কোনো সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি।
পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না করতে পারা বা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। পলিথিনের কতগুলো তথাকথিত সুবিধা রয়েছে যেমন- পলিথিন সবার কাছে অত্যন্ত সহজলভ্য অর্থাৎ চাহিদা মাত্রই পাওয়া যায়। এটি সুলভে পাওয়া যায় বলে দোকানদাররা নিজেদের সাশ্রয়ের জন্য বিপুল পরিমাণে পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। এটি বিনামূল্যে ক্রেতাকে দেওয়া যায় ফলে প্রায় সব দোকানেই পলিথিনের বহুল ব্যবহার রয়েছে।
পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের যত উদ্যোগ
প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গত ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না, ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না এবং বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখার নির্দেশ দেন তিনি।
এ ছাড়া ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। উপদেষ্টা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইএসডিও’র সঙ্গে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি, পাট বা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপারশপের কর্তৃপক্ষ ও উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।
পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে যা করা প্রয়োজন
প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সামাজিক জাগরণ তৈরি করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে ট্যুরিস্ট পুলিশসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। নগর এলাকায় পলিথিনমুক্ত বাজারের মডেল তৈরি করা যেতে পারে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে গণসচেতনতামূলক টিভিসি প্রচার এবং সুপারশপসহ বড় বড় বাজারগুলোর সামনে বিলবোর্ড স্থাপন করে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা যেতে পারে।
এ ছাড়া পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কার্যকর ভূমিকাই পারে পলিথিনের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ।
এখন কাগজ, পাট, তন্তু, পাতা ও কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে পারে। পাটের সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী। পাটের ও কাগজের ব্যাগের ইতিবাচক দিক, সাশ্রয়ী দাম ও সহজপ্রাপ্তির বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
এসএইচআর/এনএফ