এক বছরেও শেষ হয়নি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ
এখনও চোখ রাঙাচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। দেশে এ ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলেও জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা করোনা পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট জনবলের ঘাটতি থাকায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তাদের সংখ্যা অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যারা আছেন তাদের দিয়ে দেশে করোনা পরীক্ষা আর বাড়ানো সম্ভব নয়। তারা নিয়মিত এসব পরীক্ষা চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুততম সময়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া জরুরি।
গত বছরের ২৯ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে ৮৮৯ জনকে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এ পদে ২৩ হাজার ৫২২ জন চাকরিপ্রার্থী গত বছরের ১২, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা গত ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ হলেও ‘অনিয়মের অভিযোগ’ এনে আটকে দেওয়া হয় ফল
গত বছরের ২৯ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে ৮৮৯ জনকে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এ পদে ২৩ হাজার ৫২২ জন চাকরিপ্রার্থী গত বছরের ১২, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা গত ২২ ফেব্রুয়ারি শেষ হলেও এখনও তাদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ-২০২০ বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান ডা. হাসান ইমামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিয়োগটা তো মোটামুটি রেডি ছিল, কিন্তু কয়েকটি পত্রিকায় এ নিয়ে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তা আটকে যায়। প্রকাশের একেবারে শেষ মুহূর্তে মৌখিক পরীক্ষার ফলও স্থগিত রাখা হয়। এটি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিয়োগ দিতে পারছি না।’
তদন্ত প্রতিবেদন পেতে আর কতদিন সময় লাগবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি তো অনেকদিন হলো গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রতিবেদন রেডি হয়নি। প্রতিবেদন জমা হলেই বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে বলা যাবে। যদি এখানে অনিয়মের কিছু পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো এ নিয়োগ বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়ে থাকে, তাহলে শিগগিরই এটি সম্পন্ন করা যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নিয়োগের কোনো অগ্রগতি নেই। যদিও নিয়োগটা আমরা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এনেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় পরীক্ষা নিয়ে অনিয়মের খবর আসায় আটকে গেছে।’
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চিকিৎসাবিদরা বলছেন, সহসা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট না বাড়ালে ভয়াবহ বিপদে পড়তে হবে। কারণ, পরীক্ষা (করোনা) না বাড়াতে পারলে রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এ পরীক্ষা খুবই সংবেদনশীল। নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে যথাযথ পরীক্ষা হলো কি না— সব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। তাড়াহুড়া কিংবা কাজের চাপে ভুল হয়ে করোনা নেগেটিভ এলে বিপদ আরও বাড়বে। এজন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত লোকবলের বিকল্প নেই। এখন জরুরি ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছি। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ছাড়া স্যাম্পল (নমুনা)কালেকশন কে করবেন? এটা তো অপেশাদার লোকদের কাজ নয়। সরকার চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দিয়েছে, ভালো কথা। মেডিকেল টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ রোগের নমুনা পরীক্ষায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ভারত যেখানে প্রতিদিন তিন/চার লাখ করে নমুনা পরীক্ষা করে, সেখানে আমাদের সংখ্যা মাত্র ১০/১৫ হাজার। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে ‘উদাসীনতা’
দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ আটকে থাকার বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা হিসেবে দেখছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। এ বিষয়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ-২০২০ বাস্তবায়ন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এম টি তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হচ্ছে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সদিচ্ছা নেই। যদি সদিচ্ছা থাকত, তাহলে একটা নিয়োগ এতদিন আটকে থাকত না। করোনার প্রায় দেড় বছর পার হতে চলল, আমরা কাজ করতে করতে এখন ক্লান্ত।’
তিনি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় মাত্র একজন টেকনোলজিস্ট করোনার নমুনা সংগ্রহ করছেন। এটি তার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। এক্ষেত্রে তিনি যতই দক্ষ হন না কেন, একা করলে ফলাফল নেগেটিভ আসতে পারে। আবার অনেকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন না। এ কারণে নমুনা সংগ্রহের আগ্রহ হারাচ্ছেন কেউ কেউ।
তৌহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক নামক নন মেডিকেল পার্সনকে দিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে নিয়োগ প্রদান অত্যন্ত জরুরি।’
বাংলাদেশ গ্রাজুয়েট মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এস এম সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা ঝুঁকি নিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করছেন। কয়েকটি হাসপাতালে সংক্রমণের পর চিকিৎসক-নার্সদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পাঠানো হচ্ছে না। কারণ, টেকনোলজিস্টরা কোয়ারেন্টাইনে গেলে সেখানে কাজ করার কেউ থাকেন না।’
তিনি আরও বলেন, দেশে ১২ বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কিছু নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলে কার্যক্রম শুরু হলেও মাঝপথে আটকে আছে। লিখিত পরীক্ষা শেষে ভাইভা নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আশা করি, খুব দ্রুতই এর সমাধান হবে।
কবে নাগাদ নিয়োগ- জানে না স্বাস্থ্য অধিদফতর
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আমরা গত বছরের জুনে নিয়োগের উদ্যোগ নেই। গত ডিসেম্বরে আমরা লিখিত পরীক্ষা নেই এবং ফেব্রুয়ারিতে ভাইভা নেওয়া শুরু করি। এর মধ্যেই মিডিয়াতে কিছু অনিয়মের কথা আসে। ফলে এটা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দেবে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’
কবে নাগাদ তদন্ত কাজ শেষ হবে বা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে তদন্ত প্রতিবেদন পেলে খুব শিগগিরই আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারব, আশা করি।’
টিআই/আরএইচ/এমএআর/