আবেদন-নিবেদন ব্যর্থ, নির্বাচনের বাইরেই থাকছে ১৮-১৯ সেশন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভোটাধিকার হারাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে ডাকসুর দাবি নিয়ে সক্রিয় থাকা ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের ভোটার বা প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
ডাকসু নির্বাচন কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টার পরামর্শে জানিয়েছে, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর কাউকে ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা আইনবিরোধী হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টার মতে, কেবল নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থী বা পরীক্ষাসম্পন্নদের অন্তর্ভুক্তি আইনি জটিলতা তৈরি করবে।
ফল প্রকাশ, ছাত্রত্বের সমাপ্তি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ এবং অনেকের ফল প্রকাশিত হয়েছে। ডাকসুর তফসিল ঘোষণার আগে বাকি ফলাফলও প্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে। ফলে আইনি জটিলতার কারণে তাদের আর ‘বর্তমান শিক্ষার্থী’ হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করেছে। বছরের শুরু থেকে আলোচনার নামে নির্বাচন পিছিয়েছে। ফলে উক্ত সেশনের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ফল প্রকাশ হয়ে গেছে।
শেষ ভরসা এমফিলও হাতছাড়া
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ হওয়া অনেক শিক্ষার্থী শেষ ভরসা হিসেবে এমফিলে ভর্তি হয়ে ছাত্রত্ব বজায় রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এমফিলের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হতে আগস্ট পর্যন্ত সময় লাগবে। আর ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হবে ২৯ জুলাই। তাই এ সুযোগ কাজে লাগানোর বিষয়টিও এখন হাতছাড়া হতে চলেছে।
বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ডাকসু শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এটি ছিল ছাত্ররাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম মঞ্চ। সেই মঞ্চ থেকে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে বঞ্চিত করা শুধু আইনি নয়, নৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশাসন যদি সময়মতো নির্বাচন করত, আজ এই সমস্যা তৈরি হতো না। আসলে এটি প্রশাসনের ব্যর্থতা, যার শিকার হচ্ছি আমরা শিক্ষার্থীরা।
ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষোভ, প্রশাসনের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জালালউদ্দীন মোহাম্মদ খালিদ প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলেন, প্রশাসনের ডাকসু কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা তো আছেই। তারা আমাদের দেখিয়েছে যে আন্তরিকতা আছে, কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রশাসন তার বিপরীত কাজ করেছে।
খালিদ অভিযোগ করেন, ১৮-১৯ সেশনের বিষয়ে প্রশাসন লিগ্যাল অ্যাডভাইজার নিয়োগ করেছে। তারা নিজেদের মতো করে একটি লিগ্যাল অপিনিয়ন তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে আমাদের সেশনের কোনো শিক্ষার্থীকে ডাকসুতে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ আমরা ইউনিভার্সিটির বাইরের একজন উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন- ইউনিভার্সিটি যদি চায়, তাহলে নতুন করে মতামত নিয়ে ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া সম্ভব। তাতে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হবে না।
তিনি বলেন, আমরা এই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানালেও তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, দ্বিতীয়বার আর কোনো মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা আন্তরিকতার কথা বললেও বাস্তবে আমরা তার প্রমাণ দেখিনি।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন মনে করে এমফিল চালু করল, দুবার বিজ্ঞপ্তিও দিলো। কিন্তু এমন এক এমফিল চালু করল, যেটাতে কেউ কেউ সুযোগ পাবে, কেউ কেউ পাবে না। তাহলে এটা আবার কেমন এমফিল চালু করা হলো?
তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকে ভেতর থেকে ডাকসু বাতিলের জন্য কাজ করছে। যারা চায় না শিক্ষার্থীরা নিজেদের নেতৃত্ব থেকে শক্তিশালী হোক, নিজেদের অধিকারের কথা বলতে পারুক- তারাই এই অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ স্টাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখলে রাখতে চায় এবং ডাকসুর সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্তত একটা নিয়মের ভেতর ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ছিল ১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়া।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের অনেকেরই এখনো ছাত্রত্ব আছে। ছাত্রত্ব থাকার ভিত্তিতে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার বলে আমরা মনে করি। যাদের মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে, তাদের বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যাখ্যা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আইনি জটিলতার কারণে এই শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার দেওয়া সম্ভব নয়। গত ১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ডাকসু নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, সব ছাত্রসংগঠন এই সেশনকে নির্বাচনে রাখার দাবি জানিয়েছিল, আমরাও গুরুত্ব দিয়েছিলাম। তবে আইনি পরামর্শ অনুযায়ী যাদের ছাত্রত্ব নেই তাদের নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করলে পরবর্তী সময়ে আইনি জটিলতার আশঙ্কা থাকে।
তিনি বলেন, যাদের ছাত্রত্ব নেই, তাদের যদি নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধে যে কেউ আদালতে গিয়ে রিট করতে পারে। এতে নির্বাচন আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আইনি পরামর্শ চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন লিখিত মতামত দিয়েছেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন বরাবর দেওয়া মতামতে উল্লেখ করেন, ডাকসু সংবিধানের ৪(খ) ও ১৪(ক) ধারা অনুযায়ী মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করা শিক্ষার্থীরা ডাকসু বা হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার কিংবা প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নন। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সেশনের যেসব শিক্ষার্থীর মাস্টার্সের ফল প্রকাশিত হয়েছে, তারা আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
অ্যাডভোকেট রায়হান উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা রাখলেও ৪(খ) ও ১৪(ক) ধারা এমনভাবে সংশোধন করা সম্ভব নয়, যাতে মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ছাত্র ঘোষণা করা যায়। প্রশাসনিক আইনের দৃষ্টিতে এমন সিদ্ধান্তকে ওয়েডনেসবারি অযৌক্তিকতা নীতির পরিপন্থী হিসেবে গণ্য করা হবে এবং আদালতে তা বাতিলযোগ্য হবে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩-এর ২৪ ধারা উল্লেখ করে বলেন, মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ছাত্র ঘোষণা করা এই ধারার পরিধির বাইরে যাবে। সিন্ডিকেটের এমন সিদ্ধান্ত আদালতে টিকবে না।
প্রসঙ্গত, ডাকসু সংবিধানের ৪(খ) ও ১৪(ক) ধারা অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের যেসব শিক্ষার্থীর মাস্টার্স ডিগ্রির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তারা এবারের ডাকসু বা হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার কিংবা প্রার্থী হওয়ার জন্য যোগ্য নন।
এসএআর/এমএসএ