‘অসামান্য অবদান’ কোটার প্লটগুলোর কী হবে?

রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ‘অসামান্য অবদান’ কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় বিগত সরকারের আমলে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ‘অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলস’-এর ১৩/এ উপবিধির অধীনে প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। যা ওই সময় ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
অভিযোগ ওঠে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর এসব বিতর্কিত বরাদ্দ বাতিলের দাবি ওঠে। কিন্তু এক বছর পার হলেও এখনও প্লটগুলো বাতিল করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউকের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব, প্লট ও ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও বরাদ্দের নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই নিরীক্ষা শেষ করতেও বলা হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর এসব বিতর্কিত বরাদ্দ বাতিলের দাবি ওঠে। কিন্তু এক বছর পার হলেও এখনও প্লটগুলো বাতিল করা হয়নি
কারা পেলেন এই প্লট
বিশেষ এই কোটায় শুধু মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ আদর্শের রাজনীতিকই নন; তালিকায় আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক এবং আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের অফিস সহকারী-পিয়নও।
রাজউকের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প’। মধ্যবিত্তদের আবাসন চাহিদা মেটাতে এটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। যদিও পূর্বাচলের এই জমি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। প্রথম পর্যায়ের লটারির মাধ্যমে তাদের ১৬৩২টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
এছাড়া, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিজীবীদের জন্য ৬৫৪টি, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের জন্য ৪৭২টি, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ৫৯১টি, প্রবাসী কোটায় ৫৯১টি, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২৯৬টি, সচিব কোটায় ২৪টি, আইনজীবী কোটায় ১১০টি, বিচারপতি কোটায় ১৪টি, সংসদ সদস্য কোটায় ৫৭টি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোটায় ৫৭টি এবং অন্যান্য কোটায় ১৮১টি, শিল্পী কোটায় ১৫১টি ও সাংবাদিক কোটায় ৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। লটারির পরেও বিভিন্ন সময় পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় সরকারের ইচ্ছামতো।
‘অসামান্য অবদান’ কোটার বিষয়ে বলা হয়— মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী, সরকারি চাকরিজীবী ও রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিরা এই কোটায় প্লটের আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া, রাষ্ট্র বা সরকার যদি কাউকে বিশেষ অবদান রেখেছেন বলে মনে করে, তাহলে তিনি প্লট পাবেন। এই নিয়ম ব্যবহার করে প্লট বরাদ্দ দিতে থাকে রাজউক। যা সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসে এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে।
বিশেষ এই কোটায় শুধু মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ আদর্শের রাজনীতিকই নন; তালিকায় আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক এবং আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের অফিস সহকারী-পিয়নও
এখন এত বেশি সংখ্যক বরাদ্দ দেওয়া প্লট খুঁজে বের করা, আইনি প্রক্রিয়া, সিদ্ধান্ত নেওয়া, বাতিল করা— সবমিলিয়ে এই ‘অসামান্য অবদান’ চক্করই এখন রাজউকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্লট বরাদ্দের পেছনের গল্প
জানা গেছে, গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি আসতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পছন্দের ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যানদের কাছে চিঠি পাঠাতেন। তখন তড়িঘড়ি করে সুবিধাজনক স্থানে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই ধারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের পাঁচ সদস্যও পূর্বাচলে ছয়টি প্লট বরাদ্দ পান।
আরও পড়ুন
রাজউকের ‘অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলস’-এর ১৩/এ উপবিধির (অসামান্য অবদান) অধীনে এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হতো। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের আগেও ১৯৬৯ সাল থেকে বৈষম্যমূলক হিসেবে বিবেচিত ‘১৩ ধারা’ বিদ্যমান ছিল। ১৯৮৬ সালে এক দফা সংশোধনের পর এটি ‘১৩/এ’ ধারা এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সংশোধিত গেজেটে ১৩ এ (১) এ, বি, সি বিধি প্রণয়ন করে।
বরাদ্দ দেওয়া এসব প্লটের এখন কী হবে
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ পতনের আগ পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে হাজারেরও বেশি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউককে এসব প্লট বাতিল করতে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, প্লটপ্রাপ্তদের চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তালিকা করা হচ্ছে। সেগুলো হলো- ১. যারা জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন, ২. যারা কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করলেও রেজিস্ট্রি করেননি, ৩. যারা বরাদ্দ পেয়েও কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করেননি এবং ৪. যারা বরাদ্দ পেয়ে কোনো কিস্তি পরিশোধ করেননি।
তালিকা তৈরির পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে— বলছে রাজউক।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি আসতো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পছন্দের ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যানদের কাছে চিঠি পাঠাতেন। তখন তড়িঘড়ি করে সুবিধাজনক স্থানে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই ধারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের পাঁচ সদস্যও পূর্বাচলে ছয়টি প্লট বরাদ্দ পান
এদিকে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সংরক্ষিত কোটা ও অসামান্য অবদান কোটায় রাজউকের বরাদ্দ দেওয়া প্লটগুলো পর্যালোচনার জন্য আদালত একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিধিমালায় ‘অসামান্য অবদান’ সংক্রান্ত ১৩/এ উপবিধি ও সংরক্ষিত কোটা সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ৭ নম্বর ধারা বাতিল করেছে।
আরও পড়ুন
পাশাপাশি, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে হাইকোর্ট তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তাদের ১২০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নেওয়ায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ছয়জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে। হাইকোর্ট একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। কমিটি যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট প্রকাশ করবে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
একই নামে একাধিক প্লট, যাচাই করবে রাজউক
কারও নামে একাধিক প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ থাকলে তাও যাচাই করবে রাজউক। এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেছে সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়েছে, রাজউকের সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একাধিক বরাদ্দ যাচাই করা হবে। দুদক, সিআইডি, এনবিআরসহ বিভিন্ন সংস্থার চাওয়া প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সহকারী ও উপ-পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব প্লটের রেজিস্ট্রেশন হয়নি, প্রাথমিকভাবে এমন শতাধিক প্লট বরাদ্দ বাতিল করতে পারে রাজউক।
রাজউকের প্লট বরাদ্দের নিয়ম
রাজউক ১৯৮৪ সালের বিধিমালা অনুযায়ী প্লট বরাদ্দ দিয়ে আসছে। এতে বলা আছে, সরকার চাইলে যে কাউকে যে কোনো প্লট বরাদ্দ দিতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ প্লট রাজউক নীতিমালা মেনে বরাদ্দ দেয়। বাকি ১০ শতাংশ থাকে সরকারের বিশেষ কোটা। এই কোটার আওতায় সরকার যে কোনো নাগরিককে প্লট দিতে পারে, যদি তিনি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখেন।
আরও পড়ুন
এই ১০ শতাংশ বিশেষ কোটার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়। সরকার যাকে যোগ্য মনে করে, তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হয়ে বরাদ্দের চিঠি রাজউকের কাছে আসে এবং এরপর সেই ব্যক্তি প্লট পান।
এ বিষয়ে রাজউকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এতদিন যত প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা ১৩/এ উপবিধি মোতাবেক। এখানে বিষয়টি ছিল, রাষ্ট্র যাকে যোগ্য মনে করবে তাকে প্লট দিতে পারবে। এছাড়া, রাজউকের প্লট বাতিলের নীতিমালায় বলা আছে, যদি কারও একাধিক প্লট থাকে তাহলে একটি ছাড়া অন্যগুলো বাতিল হবে। এখন সংশোধনের পর এগুলো বাতিল করতে পারবে সরকার। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে রাজউক সেই নির্দেশনা পালন করবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে রাজউক বোর্ড সভায় সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হতো। ফলে বোঝা যায় রাজউকের ওপর আমলাতন্ত্রের কত প্রভাব ছিল। এখন সময় এসেছে রাজউকের সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সংস্কার করে সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার।’
রাজউকের ১৬ বছরের সব কার্যক্রম নিরীক্ষার নির্দেশ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব, প্লট ও ফ্ল্যাট হস্তান্তর এবং বরাদ্দসহ সব ধরনের কার্যক্রম নিরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গত ১০ আগস্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় বিষয়টি।
সেখানে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিদপ্তরের কার্যপরিধি এবং গত ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। জনস্বার্থে এই নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিদপ্তর। এর আওতায় নিরীক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন, আইন ও বিধিবিধান মেনে কার্যক্রম পরিচালনা, নিরীক্ষা টিমের সদস্যদের তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এবং নিরীক্ষা শুরুর আগে রাজউককে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। নিরীক্ষা শেষে বিস্তারিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দিতে হবে।
এএসএস/এমএআর/
