বাংলার ‘টেসলা’ চলে গুলশান-বনানীতে

বছরখানেক আগেও ঢাকার গুলশান, বনানীতে চলত প্যাডেলচালিত রিকশা। সেই রিকশার ছিল নির্দিষ্ট রং, ছিল ভাড়ার তালিকাও। নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশাই শুধু চলত এসব এলাকায়। কেউ চাইলে বাইরে থেকে রিকশা এনে চালাতে পারত না। আবার এসব এলাকার রিকশাও নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে পারত না।
কিন্তু গত এক বছর ধরে গুলশান-বনানী এলাকায় এই ছন্দ আর নেই। সবকিছু বদলে গেছে। অন্য এলাকার মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢুকে পড়েছে এসব এলাকাতেও। শুধু তা-ই নয়, বাংলার ‘টেসলা’ খ্যাত এ বাহন রীতিমতো আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজধানীর মূল সড়ক, সরু গলি, ওভারব্রিজেরনিচে কিংবা স্কুল গেট– সর্বত্রই ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। গুলশান-বনানীতেও এই রিকশা ঢুকে পড়ায় বিরক্ত এখানকার বাসিন্দা ওচলাচলকারীরা। তারা জানান, সিগন্যাল ভাঙা, উল্টোপথে চলা, যাত্রী নিয়েবেপরোয়া গতিতে ছোটা– সবই চলছে নির্দ্বিধায়। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।এতে দ্রুতগতির গাড়ি থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী– সবাই পড়ছেন ঝুঁকির মুখে।
বাংলার ‘টেসলা’ নামে পরিচিত ব্যাটারিচালিত এ রিকশা এখন ঢাকায় নতুন চিত্র আঁকছে। একবার যাত্রী উঠলেই চালকেরা যেন বনে যান অদৃশ্য রেসার– উচ্চগতির সঙ্গে হঠাৎ ব্রেক, হঠাৎ মোড় নেওয়া; যা যাত্রীদের জন্য এক আতঙ্কের যাত্রায় রূপ নেয়। সবমিলিয়ে এই বাহন নিয়ে বিরক্ত বাসিন্দা-চলাচলকারী সবাই।
রাজধানীর মূল সড়ক, সরু গলি, ওভারব্রিজের নিচে কিংবা স্কুল গেট– সর্বত্রই ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট। গুলশান-বনানীতেও এই রিকশা ঢুকে পড়ায় বিরক্ত এখানকার বাসিন্দা ও চলাচলকারীরা। তারা জানান, সিগন্যাল ভাঙা, উল্টোপথে চলা, যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছোটা– সবই চলছে নির্দ্বিধায়। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে দ্রুতগতির গাড়ি থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী– সবাই পড়ছেন ঝুঁকির মুখে
যেমন ছিল গুলশান-বনানীর রিকশার চিত্র
কিছুদিন আগেও গুলশান-বনানীতে চলত না ব্যাটারিচালিত রিকশা। শুধু নির্দিষ্ট সংখ্যক ও নিবন্ধিত হলুদ রঙের প্যাডেলচালিত রিকশা চলাচল করত। কিন্তু গেল বছর থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢুকে পড়েছে ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান-বানানীতে। এসব বাহনের কারণে এই এলাকার সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে যেন কেউ নেই!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে যখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করত পারত না তখন এসব এলাকায় একটি প্যাডেলচালিত নিবন্ধিত রিকশার দাম ছিল পাঁচ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ঢাকার অন্য এলাকায় প্যাডেলচালিত নতুন একটি রিকশা কিনতে খরচ হতো সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। পুরোনো রিকশা পাওয়া যেত আরও কম দামে মাত্র ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। কিন্তু রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে রিকশা চালাতে চাইলে কেন গুনতে হতো চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা? এসব রিকশায় বাড়তি কোনো প্রযুক্তি আছে? চালকের কষ্ট কমানোর মতো বিশেষ কোনো যন্ত্র আছে? না, এমন কিছুই নেই। রিকশার কাঠামো, আসন ও নকশা– সবই অন্য সাধারণ রিকশার মতো। তাহলে কেন এত বাড়তি দাম?
আরও পড়ুন
জানা যায়, এত দামের মূল কারণ এসব রিকশার বিশেষ নিবন্ধন প্লেট। সীমিত সংখ্যক রিকশাকে এসব এলাকায় চলাচলের অনুমতি দেয় সিটি কর্পোরেশন। সেই নিবন্ধনের কারণে এক একটি রিকশার দাম দাঁড়ায় চার/পাঁচ লাখ টাকা। নিবন্ধন ছাড়া কোনো রিকশাই গুলশান-বনানীতে চলতে পারত না। নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যাও ছিল সীমিত।
গুলশান ও বনানীতে ওই সময় নিবন্ধিত রিকশা ছিল প্রায় ৪০০টি করে। চলত ১০০টি করে রিকশা। নিবন্ধনের জন্য সোসাইটি কোনো ফি নিত না। তবে, বছরে একবার চালকের কটি, নম্বর প্লেট ও ভাড়ার তালিকা টানানোর জন্য সোসাইটি ভেদে এক থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হতো
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর ওই এলাকায় রিকশা ও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাস দেড়েক পর আবার তা চালু হয়। তবে, কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে সিটি কর্পোরেশন ওই এলাকায় রিকশার সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর গুলশান, বারিধারা, বনানী ও নিকেতনের বাসিন্দাদের সংগঠন সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধন বা লাইসেন্স আছে, শুধু এমন রিকশাকে তাদের নিজস্ব নিবন্ধনের আওতায় আনে। প্রতিটি রিকশাকে একটি করে নম্বর প্লেট দেওয়া হয়, যা রিকশার সামনে টানিয়ে রাখতে হয়। এছাড়া, রিকশাচালকদের পরিচয়পত্র ও বিশেষ কটি পরতে দেওয়া হয়, রিকশার পেছনে যুক্ত করে দেওয়া হয় ভাড়ার তালিকা।
গুলশান ও বনানীতে ওই সময় নিবন্ধিত রিকশা ছিল প্রায় ৪০০টি করে। চলত ১০০টি করে রিকশা। নিবন্ধনের জন্য সোসাইটি কোনো ফি নিত না। তবে, বছরে একবার চালকের কটি, নম্বর প্লেট ও ভাড়ার তালিকা টানানোর জন্য সোসাইটি ভেদে এক থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হতো।
বর্তমানে বিশৃঙ্খল ভজকট অবস্থা
বর্তমানে গুলশান-বানানীর মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি– এমন কোথাও নেই যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে না। ট্রাফিক পুলিশ, সোসাইটি, সিটি কর্পোরেশন, এলাকাবাসী, স্থানীয় বাসিন্দা, যাত্রী কেউই এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারা এসে সরাসরি ঢুকে যাচ্ছে এসব এলাকায়। অদক্ষ এসব চালকের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা।
আগে নিবন্ধিত রিকশাচালকেরা এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল মানতে পারছেন না। তারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
প্রায় ছয় বছর ধরে গুলশানে নিবন্ধিত প্যাডেলচালিত রিকশা চালান জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, গুলশান-বনানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢুকে এলাকার পরিবেশই নষ্ট করে দিয়েছে। হুটহাট রিকশা টান দিয়ে এদিক-ওদিক চলে যায়, চিনে না কিছুই; কিন্তু দ্রুতগতিতে চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় নিয়মিত। এলাকাবাসী, কোনো যাত্রীই এই রিকশা পছন্দ করেন না। কিন্তু তারা এসে ভিড় জমিয়ে রাখেন। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা ওঠেন। তবে, এমন অনেক যাত্রী আছেন যারা আমাদের প্যাডেলচালিত রিকশা দেখলে আর ব্যাটারির রিকশায় ওঠেন না। এসব রিকশা ঢুকে আমাদের চলার সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। যাত্রী, এলাকাবাসীসহ আমরা সবাই ব্যাটারিচালিত রিকশার বিশৃঙ্খলায় বিরক্ত, সবাই চায় এসব রিকশা বন্ধ হোক।
গুলশান-১ নম্বর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান বলেন, আগে আমরা খুব সুন্দর পরিবেশের মধ্যে বাস করতাম। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশা গুলশান-বনানী এলাকায় ঢুকে পুরো এলাকার পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে। এখন রাস্তা পার হতেও ভয় লাগে, কখন কোন দিক থেকে এসে এসব নিয়ন্ত্রণহীন রিকশা গায়ের ওপর তুলে দেয়! আগে ভেতরের সড়ক, অলিগলিতে যানজট হতো না। এখন তাদের কারণে প্রতিটি জায়গায় প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে। এখানে বিদেশিসহ উচ্চ পদস্থ মানুষজন বাস করেন। যে কারণে আগে নিয়ন্ত্রণ ছিল চলাচলের। কিন্তু এসব ব্যাটারির রিকশা এসে পুরো এলাকার সৌন্দর্য, শৃঙ্খলা নষ্ট করে বিমানের গতিতে চলাচল করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।
ভাড়া নিয়েও চলছে নৈরাজ্য। বনানী থেকে গুলশান-১ নম্বরের যাত্রী খাদেজা খাতুন বলেন, আমরা আগে নির্দিষ্ট ভাড়ায় চলাচল করতাম। কিন্তু এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা আসায় ভাড়ার তালিকা আর কেউ মানে না। তাদের রিকশার কারণে ভয় হয় চলাচল করতে। বাধ্য হয়ে চলতে হয়। এসব রিকশায় উঠলে মনে হয় তারা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে নিজের মধ্যে ভয় আরও বেড়ে গেছে। রাস্তা পার হওয়ার সময় আগে দেখি এসব রিকশা আসছে কি না। আমরা চাই ব্যাটারিচালিত রিকশা যেন গুলশান-বনানী এলাকায় না চলে।
বন্ধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ গুলশান কর্তৃপক্ষ
গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে গুলশান এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও গুলশান সোসাইটি। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল বন্ধ ঘোষণার প্রথম দিন সকালে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও চালকদের বিক্ষোভের মুখে দুপুরের পর গুলশান ও বনানী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
এর আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে সোসাইটি ও ডিএনসিসির উদ্যোগে ব্যানার টানানো ও মাইকিং করা হয়। সহায়তা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় পুলিশকে। বনানী-১১ নম্বর, বাড্ডা-গুলশান লিংক রোড, গুলশান-২, কালাচাঁদপুর ও পুলিশ প্লাজাসহ কয়েকটি জায়গায় আগের দিন সকাল থেকে অবস্থান নেয় পুলিশ ও সোসাইটির নিরাপত্তা কর্মীরা। ফলে এসব এলাকা দিয়ে গুলশানে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। তবে, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন অটোরিকশার চালকেরা। তারা দুপুরের দিকে বনানী-১১ নম্বর সড়ক থেকে রিকশা নিয়ে মিছিল বের করেন। তারা দাবি করেন, প্যাডেলচালিত রিকশা চললে ব্যাটারির রিকশাকেও অনুমতি দিতে হবে। কিছু চালক বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েন এবং বেশকিছু প্যাডেলচালিত রিকশা ভাঙচুর করেন। উদ্যোগ নেওয়ার পরও সবমিলিয়ে এক দিনও বন্ধ করে রাখা সম্ভব হয়নি ব্যাটারিচালিত রিকশা।
সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত যে বাহনটি বর্তমানে আছে তা কারো জন্য নিরাপদ নয়। দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। আমরা একটা সেফ বাহনের ডিজাইন করে নিয়েছি বুয়েট থেকে। এখন আমরা প্রোডাকশন করার অনুমতি দেব। বর্তমানে আমরা চিহ্নিত করছি কোন কোন এলাকায় কত সংখ্যক রিকশার প্রয়োজন। এরপর আমরা লাইসেন্স দেব, চেসিস নম্বর দেব। প্রথমত, একটা জোন করে আমরা নতুন রিকশা চলাচলের অনুমতি দেব। চালকদের আমরা বর্তমানে ট্রেনিং দিচ্ছি। এক লাখ রিকশাচালককে প্রশিক্ষণ দেব আমরা। ট্রেনিংয়ের জন্য তাদেরকে টাকাও দিচ্ছি আমরা।
‘নিরাপদ যে বাহন সেই বাহনই আমার নামাব। সঙ্গে অনিরাপদ যান চলাচল করতে দেব না। নতুন বাহন নামার পর তারা আর মূল সড়কে উঠতে পারবে না। তারা শুধু এলাকার ভেতরে চলতে পারবে। নতুন বাহন রাস্তায় নামবে আর পুরোনোগুলো রাস্তা থেকে ক্রমান্বয়ে সরিয়ে নেব। নতুন রিকশাগুলোতে ডিভাইস থাকবে, তারা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে পারবে না। আগামী মাস থেকে দুই জোনে এসব নতুন ডিজাইনের রিকশা আমরা নামাব। আশা করা যায় এরপর থেকে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করবে।’
এএসএস/এসএসএইচ
