অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে অটোরিকশা, দেখার কেউ নেই

ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট এখন এক নতুন বাস্তবতা। সাধারণ মানুষের সহজ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত যানটি এখন একটি বিশাল অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের উপার্জনের পথ তৈরি হলেও, এর পেছনে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। গ্যারেজ নির্মাণ থেকে শুরু করে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জিং— সবকিছুই স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
জানা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও টাকা জমিয়ে দুই-চারটি রিকশা কিনে সড়কে নামাচ্ছেন। রাজধানীর যেখানে-সেখানে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। রিকশার মেকানিকদের কেউ কেউ ধারদেনা করে, আবার অনেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কিনছেন। তবে, এই পেশার নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে নেই স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তারা প্রভাব বিস্তার করে গ্যারেজ ভাড়া দিচ্ছেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে গ্যারেজ এবং অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে চার্জের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছেন তারা।
শ্যামলীর ছোট একটি দোকানের মধ্যে আব্বাস রিকশা মেকানিক ওয়াকর্শপ। সেখানে একটি রিকশা রাখতেও কষ্ট হবে। তবে, এই ওয়ার্কশপে প্রতিদিন একটি করে ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করতে পারেন বলে জানান মেকানিক সুমন মিয়া। বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন একটি করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বানাতে পারি। এখানে মূলত দুই ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করা হয়। একটি ছাদছাড়া, আরেকটি ছাদসহ। ছাদছাড়া রিকশা ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। আর ছাদসহ ১০ হাজার টাকা বেশি লাগে। তবে, গাড়ির দাম ব্যাটারির ওপর নির্ভর করে।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, মোটা চাকার অটোরিকশার দাম লাখের ওপরে। তবে, শহরে চিকন চাকা বেশি চলে। শহরের বাইরে কিংবা আশপাশে মোটা চাকা লাগে। সেই গাড়িগুলোর দাম ৯০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকার মধ্যে পড়ে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ঢাকা উদ্যান, রায়ের বাজার, বছিলা, খিলগাঁও, মুগদা, মান্ডা, বাসাবো, মানিকনগর, রামপুরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ, শ্যামপুর, ডেমরা, উত্তরা, ভাটারা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, ময়নারটেক, মিরপুর, ভাষানটেক ও পল্লবী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার শত শত গ্যারেজ রয়েছে। বেশিরভাগ গ্যারেজ অলিগলির ভেতরে টিনশেড ঘরে তৈরি। এসব গ্যারেজ থেকে দিনের আলোয় সারা ঢাকা শহরে অটোরিকশা ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া মান্ডা, বাসাবো, মিরপুর, পল্লবী, কদমতলী, ঢাকা উদ্যান, রায়ের বাজার, বছিলা এলাকায় নতুন নতুন গাড়ি তৈরি করে বিক্রি করা হয়। এখন ছোট ছোট গ্যারেজও রিকশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ধানমন্ডির রায়ের বাজার থেকে হাজারীবাগ রোডের পাশে বেশ কয়েকটি রিকশার ওয়ার্কশপ রয়েছে। সেগুলোতে আগে রিকশা নষ্ট হলে ঠিক করা হতো। বর্তমানে এখানেই নতুন রিকশা তৈরি করা হয়। সড়কের মধ্যেই অহরহ নতুন গাড়ি তৈরি করতে দেখা যায়। শুধু একটি নয়, একাধিক ওয়ার্কশপও রয়েছে এসব এলাকায়। গ্যারেজগুলোর বাইরে নতুন কয়েকটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাখা আছে বিক্রির জন্য। হুট করে দেখলে এটাকে শুধু বিক্রয়কেন্দ্র বলেই মনে হবে। তবে, বাস্তবে এটি একটি গ্যারেজ।
গ্যারেজের কর্মচারী আউয়াল হোসেন বলেন, আমরা নষ্ট অটোরিকশা ঠিক করার পাশাপাশি নতুন রিকশা ও বডি তৈরি করি। আর মোটর, ব্যাটারি, বিভিন্ন পার্টস— এগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে নিয়ে থাকি। রিকশার পার্টসগুলো বিভিন্ন দোকান থেকে কিনে আনি। আমাদের ওয়ার্কশপে শুধু ফিটিং হয়। এরপর পুরো রিকশাটা তৈরি করে ডেলিভারি দেওয়া হয়।

ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার মেকানিক শাহ আলম বলেন, অল্প পুঁজি এবং সহজে মূলধন উঠে আসে বলে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসায় বেশি ঝুঁকছেন। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা জমা পাওয়া যাচ্ছে। আগে চীন থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি করা হলেও বর্তমানে ঢাকার অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে। চাইলেই সহজে গ্যারেজ থেকে নতুন নতুন রিকশা তৈরি করা যায়। কম পুঁজি ও সহজ প্রাপ্যতার জন্য অনেকে ৮ থেকে ১০টি রিকশা কিনে ভাড়া দিচ্ছেন। আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত মাথার ওপরে না থাকলে গ্যারেজ দেওয়া সম্ভব নয়।
গ্যারেজ মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাখার জন্য টিনশেডের ঘর বেশি জনপ্রিয়। এসব ঘরের ভেতর বাঁশ দিয়ে মাচাং তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে চাইলে চালকেরা বিশ্রাম নিতে পারেন। কোনো কোনো টিনশেড রিকশা গ্যারেজে ৫০টির বেশি রিকশা রাখা যায়। সেখানে রিকশা রাখার পাশাপাশি চার্জেরও ব্যবস্থা থাকে। রিকশাপ্রতি ভাড়া হিসেবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। তবে, প্রতিটি অটোরিকশার গ্যারেজ ভাড়া ও চার্জ বাবদ এলাকাভেদে প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকা দিতে হয়।
পশ্চিম ধানমন্ডির একটি রিকশা গ্যারেজের দায়িত্বে আছেন ইকবাল হোসেন। তিনি গ্যারেজে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ব্যাটারিচালিত তিন সিটের রিকশার জন্য ৪০০ টাকা ভাড়া নিই। আর চার সিটের জন্য ৫০০ টাকা। প্রতিটি রিকশাকে রাতে চার্জ দিয়ে রাখি। চালকেরা এক চার্জে ১৫০০-১৬০০ টাকা ভাড়া তুলতে পারেন। আর রিকশার কোনো পার্টস নষ্ট হলে মালিক তা ঠিক করে দেন। ড্রাইভারকে কিছু দিতে হয় না।’
মোহাম্মদপুরের গ্যারেজমালিক রিয়াদ বলেন, এখন সব চালকই অটোরিকশা চালাতে চান। সাধারণ প্যাডেল রিকশা চালাতে চান না। আগে গ্রাম থেকে আসা মানুষ এই রিকশা চালাতেন, যাদের বেশিরভাগই রিকশার মালিক ছিলেন না। তবে, ব্যাটারিচালিত রিকশার ক্ষেত্রে দৃশ্যপট ভিন্ন।
বেশিরভাগ ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিকানা প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের হাতে। তারা যন্ত্রাংশ আমদানি করে নিজেরাই এসব রিকশা তৈরি করে বিক্রি বা ভাড়া দেন। চালক নিজেই গাড়ির মালিক, সেই সংখ্যা খুবই কম। এই ব্যবসায় বিনিয়োগ কম হলেও লাভ বেশি।
‘সাধারণত দৈনিক হিসেবে ব্যাটারিচালিত রিকশার ভাড়া ৪০০ টাকা, স্টিলবডি রিকশা ৫০০ টাকা, মিশুক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, বোরাক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। তবে, বোরাকের বিদ্যুৎ খরচ চালককে বহন করতে হয়।’

হাজারীবাগের একটি গ্যারেজের দায়িত্বে থাকা মেকানিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগের তুলনায় গ্যারেজ বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিটি রিকশার গ্যারেজে নতুন গাড়ি বানানো হচ্ছে। বিগত সময়ে গাড়ি বানানো হতো, তবে লুকিয়ে লুকিয়ে। এখন রাস্তার মধ্যেই বানানো হচ্ছে। এই এলাকার বেশিরভাগ গ্যারেজই আওয়ামী লীগ আমলে গড়ে ওঠা। গ্যারেজ ও রিকশার মালিকদের বেশিরভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা ম্যানেজ করে চলছেন।
তেজগাঁও এলাকার রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালাচ্ছি। সবসময় চালাই না। এলাকায় কাজ না থাকলে ঢাকায় এসে মাঝেমধ্যে চালাই। প্রতিদিন ৫০০ টাকা ভাড়া দিই। আমার মালিকের ২৫টি ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। আওয়ামী লীগ আমলে টোকেন দিতেন, এখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা কিছু টাকা নিচ্ছেন।
কম পুঁজিতে বেশি লাভ হয়— জানিয়ে রিকশাচালক সোহেল রানা বলেন, ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে রিকশা কিনে ভাড়া দিলে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা আসে। অতিরিক্ত কোনো খরচ নেই। নতুন গাড়িতে সমস্যাও থাকে না। গ্যারেজ ভাড়াও কম নয়। দৈনিক ১৫০ টাকা লাগে।
এমএসআই/এসএম
