করোনা মোকাবিলা প্রকল্পে ৫০৪ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব
>> ব্যয় ৫৬৮৮ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের
>> ভ্যাকসিন ক্রয়, পরিবহন ও সংরক্ষণে ব্যয় হবে ৪৩১৪ কোটি
>> দুটি গাড়ির ভাড়া জন্য চাওয়া হয়েছে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা
>> মূল ডিপিপিতে না থাকলেও সংশোধনে ১৫ কোটির আবদার
করোনা মোকাবিলায় ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প সংশোধনীর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সংশোধনী প্রস্তাবনায় এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। যা প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় ৫০৪ শতাংশ বেশি। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হবে ছয় হাজার ৮১৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন বা জিওবি থেকে ২১২ কোটি ৪৩ লাখ এবং বিশ্ব ব্যাংক ও চীনের সংস্থা এআইআইবি’র ঋণ থেকে ছয় হাজার ৬০৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা প্রকল্পের জন্য সংস্থান করা হবে বলে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল হতে ২০২৩ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত এপ্রিলে প্রকল্পটি হাতে নেয়। প্রকল্পটি জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী তখন অনুমোদন দেন। জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তখন মূল প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ১২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার কার্যপত্র তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক বিভাগ। ওই কার্যপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার শুরুতে দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফলে কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে বলে বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে নতুন প্রস্তাবে কিছু অসঙ্গতি দেখা গেছে। এগুলো নিয়ে পিইসি সভায় ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।’
পিইসি সভার কার্যপত্রে দেখা গেছে, প্রকল্পে সংশোধনীর মাধ্যমে ভ্যাকসিন কেনা, পরিবহন, সংরক্ষণ বাবদ মোট চার হাজার ৩১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু পরিমাণ বা একক মূল্য উল্লেখ করা হয়নি। কোন দেশ থেকে কী উপায়ে কতদিনের মধ্যে ভ্যাকসিন আনা হবে এবং তা কীভাবে বিতরণ করা হবে সে বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাবে কিছু বলা হয়নি।
এছাড়া বাৎসরিক বরাদ্দ বিভাজনে প্রকল্পটির অনুকূলে দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কার্যক্রমের জন্য কত টাকা ব্যয় হবে এবং অর্থের সংস্থান কীভাবে করা হবে তাও সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়নি।
পিইসি সভার কার্যপত্র থেকে আরও জানা গেছে, মূল প্রকল্পে পরামর্শক খাত ছিল না। তবে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে পরামর্শক (টেলিমেডিসিন) খাতে ১৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া নন-রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং (রেনোভেশন) খাতে সাত কোটি ১১ লাখ টাকা, নন-রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং খাতে ৩১২ কোটি ৮০ টাকা, কমিশন (এজেন্ট) খাতে আড়াই কোটি টাকা, ম্যানেজমেন্ট চার্জ বাবদ ৫০ লাখ টাকা, কেমিক্যাল (বিএজেন্ট, পিসিআর ও র্যাপিড টেস্ট কিট) বাবদ ৩১ কোটি ৮৯ লাখ টাকার সংস্থান রেখে নতুন অঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে রাজস্ব অঙ্গে বেশকিছু খাতের বিভাজন দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে সেমিনার, অডিও-ভিডিও প্রডাকশন, বইপত্র ও প্রকাশনা, স্থানীয় প্রশিক্ষণ, প্রিন্টিং ও বাইন্ডিং, কনসালটেন্সি, কনজিউমেবল আইটেম রয়েছে। এগুলোর বিভাজন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সংযুক্ত করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
পিইসি সভার কার্যপত্রে দেখা গেছে, সেমিনার ও ওয়ার্কশপ খাতে ব্যয় আড়াই কোটি থেকে বাড়িয়ে পাঁচ কোটি ৪৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আউট সোর্সিং (পিআইইউ) খাতের ৯৯ লাখ টাকা ও কনসালটেন্সি (পিসিআর,আইসিএস) খাতের পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় সংশোধিত ডিপিপিতে বাড়িয়ে যথাক্রমে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা ও ৯২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। এর যৌক্তিকতা পিইসি সভায় জানতে চাওয়া হবে।
প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংশোধিত ডিপিপিতে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং আসবাবপত্রের মূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করার কথা ছিল। তবে সেখানেও বেশি ধরা হয়েছে। এমএসআর খাতে এক হাজার ১৭৬ কোটি এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি খাতে ২০২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া, সংশোধিত প্রকল্পে কম্পিউটার সফটওয়্যার খাতে বরাদ্দ করা চার কোটি ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চার কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ৬০২টি গাড়ির ভাড়া বাবদ ৩৭ কোটি টাকা ধরা ছিল। সংশোধিত প্রস্তাবনায় গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে মাত্র দুটি করা হয়েছে। গাড়ির সংখ্যা ৬০০টি কমলেও ভাড়া কমেনি সেভাবে। সংশোধিত প্রস্তাবে গাড়ির ভাড়া বাবদ ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া, একটি ডাবল কেবিন পিকআপের স্থলে বর্তমান ডিপিপিতে দুটি পিকআপ প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মূল্য প্রাক্কলনে ভুল দেখা গেছে। এটি সংশোধন করা আবশ্যক বলে জানিয়েছে পিইসি।
এদিকে জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এমএসআর হতে ইতোমধ্যে ৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অডিও-ভিডিও এবং ফিল্ম প্রোডাকশন খাতে এক কোটি ৪৩ লাখ এবং মেডিক্যাল মেশিনারি খাতে ৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছে পিইসি।
উল্লেখ্য, প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট ও ২০ শয্যায় আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ২৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। ১০টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংক্রামক হাসপাতালে পাঁচ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হবে। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় আইইডিসিআর ও বিআইটিআইডিতে মোবাইল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির শুরুতে বিশ্ব ব্যাংকের জরুরি সহায়তা তহবিল থেকে ১০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা আসে। তখন ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। পরে করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যাংকের অনুকূলে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) বাংলাদেশকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রকল্প প্রস্তাবনায় ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিশ্রুত ৫০ কোটি ডলারের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস বার বার ধরন পরিবর্তন করায় প্রকল্পে নতুন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এসআর/এইচকে/এসএম