উইমেন ফ্রেন্ডলি ও আস্থার সংস্থা হচ্ছে পিবিআই
বাংলাদেশ পুলিশে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্ত হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যাত্রা শুরুর পর ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি নিজস্ব বিধিমালা অনুমোদিত হওয়ায় মামলা তদন্তের কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস (অজ্ঞাত) মামলার তদন্ত এবং তা নিষ্পত্তি করে আলোচনায় এসেছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
সর্বমহলে আস্থার সংকট কাটিয়ে খুব শিগগিরই পিবিআই আস্থা ও ভরসা এবং উইমেন ফ্রেন্ডলি (নারীবান্ধব) তদন্তকারী সংস্থায় পরিণত হবে বলে মনে করেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘পুলিশের দুর্বলতা কাটিয়ে আমরা ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী, বিশেষ করে নারী ভুক্তভোগীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মামলা তদন্তের চেষ্টা করছি। স্পষ্ট করে বলতে চাই, তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতেই পারে, কিন্তু তদন্ত ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কোনো চাপ পিবিআই পাত্তা দেয় না, মিথ্যার সঙ্গে আমরা আপসহীন।’ সম্প্রতি ঢাকা পোস্ট-কে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
ঢাকা পোস্ট : শুরুতে পিবিআই’র প্রতিষ্ঠা এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই…
বনজ কুমার মজুমদার : ২০১১ সালে পুলিশ অ্যাক্টের একটি ধারার ক্ষমতাবলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে একটি আধুনিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা হিসেবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাত্র ৯৭০ জনবল নিয়ে এর যাত্রা শুরু। বর্তমানে ২০২০ জনবল নিয়ে পিবিআই’র মোট ৫৭টি ইউনিট কাজ করছে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকে পিবিআই’র ইউনিটসমূহ থানার মামলা (জিআর) এবং আদালতে দায়ের করা (সিআর) মামলাসমূহ তদন্ত করে আসছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর আদলে তৈরি পিবিআই এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যা মামলা, সালমান শাহ হত্যা মামলা, সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা, মোনায়েম হত্যার রহস্য উদঘাটন করে প্রশংসিত হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : পিবিআই মূলত তদন্তকারী সংস্থা। অন্য তদন্ত সংস্থা থেকে এর পার্থক্য কী? সুষ্ঠু তদন্তের ক্ষেত্রে পিবিআই গুণগত পরিবর্তন আনতে পেরেছে কি?
যোগ দেওয়ার পর এক বছর চুপচাপ কাজ করেছি। প্রেস ফেস করিনি। এই সময়টা কাজ শিখেছি। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বোঝার ও অনুধাবনের চেষ্টা করেছি, মানুষ সব সময় থানায় কেন যেতে পারেন না? মানুষ কেন থানা বাদ দিয়ে আদালতে মামলা করেন? কোন কোন অভিযোগ বেশি হয় থানায়? থানা পুলিশের সঙ্গে কোন কোন জায়গায় সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে?
বনজ কুমার মজুমদার
আমরা মনে করি, যিনি আদালতে বা থানায় যাচ্ছেন তিনি কোনো না কোনোভাবে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেই জায়গা পিবিআই অ্যাড্রেস (চিহ্নিত) করে কাজ শুরু করেছে। এখানেই পিবিআই’র বিশেষত্ব।
ঢাকা পোস্ট : সিআর মামলা তদন্তে থানা পুলিশের চেয়ে পিবিআই’র বিশেষত্ব সম্পর্কে যদি বলতেন…
বনজ কুমার মজুমদার : আদালতে দায়ের করা মামলার তদন্তে থানা পুলিশের চেয়ে গুণগত পরিবর্তন এসেছে পিবিআই’র তদন্তে। কারণ পিবিআই তদন্তে ভুক্তভোগীদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা (ভুক্তভোগী) ন্যায্য সুবিধা বেশি পেয়ে থাকেন। পিবিআই নিজে থেকে ভিকটিম বা ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। এখানে হয়রানির কোনো সুযোগ নেই। নারী ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে পিবিআই নিজেই উদ্যোগী হয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে থাকে। আমরা আদালতের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে থাকি। জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে, আইনের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে বা অপারেশনাল সাপোর্ট দরকার হলে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হই।
ঢাকা পোস্ট : মানবপাচার মামলার তদন্ত নিয়ে বাদীপক্ষের অসন্তোষ আছে। এখানে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয় না বলেও অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই’র অবজারভেশন কী?
বনজ কুমার মজুমদার : মানবপাচারের ঘটনায় কুষ্টিয়ায় একজন বিচার চেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করলেন। প্রথমে অনেকে এটি তুচ্ছ বা মামুলি মামলা ভেবেছিলেন। কিন্তু মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই। মানবপাচারের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত কিন্তু ওই পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
এর আগে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। বড় বড় মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে কয়েকজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আমার মনে হয়, তদন্ত সঠিক পথে থাকলে মানবপাচারের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাদী যে নারাজি দেন না, পিবিআই তা প্রমাণ করেছে।
ঢাকা পোস্ট : কিন্তু হত্যার অভিযোগের অধিকাংশ মামলায় বাদীপক্ষ নারাজি দেন। এসব মামলার তদন্তে পিবিআই কীভাবে কাজ করে?
বনজ কুমার মজুমদার : পিবিআই অনেক ক্লুলেস (অজ্ঞাত) হত্যা মামলার তদন্ত করেছে। তদন্তে প্রমাণ করেছে আসলেই মার্ডার (হত্যা)। আদালতে দায়ের করা এমন (হত্যা মামলা) ৩০টি মামলা তদন্ত করে প্রমাণ করেছে পিবিআই। এসব মামলার বিশেষত্ব হচ্ছে, ময়নাতদন্তে তথ্য এসেছিল ভিন্ন। কিন্তু আদালতে আমরা হত্যা হিসেবে প্রমাণ করেছি। এসব প্রমাণে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেই, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করি। তদন্ত সমন্বয়ে এক্সপার্টদের (বিশেষজ্ঞ) যুক্ত করি।
ঢাকা পোস্ট : দেখা গেছে, পুলিশের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। বাদীপক্ষ পুলিশের হয়রানির শিকার হন। পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অনেক মামলা পিবিআই তদন্ত করছে। নিজ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তদন্ত পরিচালনা কঠিন হয় কি-না?
বনজ কুমার মজুমদার : ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতেই পারেন। পিবিআই ভিকটিমকে (ভুক্তভোগী) ভিকটিম হিসেবেই দেখছে। অপরাধী পুলিশ হলেও অপরাধী হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না পিবিআই। নুসরাত মার্ডারে (হত্যা) ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে কিন্তু আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল। সেই মামলা পিবিআই তদন্ত করেছে। নয় বছর জেল হয়েছে ওসি মোয়াজ্জেমের। সুতরাং আমরা মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো কিছু্ই তুচ্ছ মনে করি না। প্রভাবশালীদের পাত্তা দেই না। কর্মকর্তাদের সোজা পথে চলতে বলেছি। যা হবার হবে।
ঢাকা পোস্ট : পিবিআই’র সবচেয়ে বেশি সফলতা কোথায়?
বনজ কুমার মজুমদার : আমাদের সবচেয়ে বেশি সফলতা মফস্বলে। যেখানে গরিব মানুষকে মারা হয়েছে, ডাকাতি হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে, প্রতিবেশীরাও সাপোর্ট দিতে পারে না। মফস্বলে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা ঘটে যা পত্রিকার পাতায় স্থান পায় না। তবে পত্রিকায় আসুক আর না আসুক পিবিআই মফস্বলের মামলা সমগুরুত্ব দিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তদন্ত করে আসছে। আমাদের অধিক সফলতাও তাই মফস্বলে।
ঢাকা পোস্ট : তদন্তের দায়িত্বের পর এখন পর্যন্ত কতগুলো মামলার নিষ্পত্তি করেছেন?
বনজ কুমার মজুমদার : তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি করেছি ৬৩ হাজারেরও বেশি মামলা। এর মধ্যে আদালতে দায়ের করা মামলা রয়েছে ৫০ হাজার ৫৫৪টি। থানায় দায়ের করা মামলা ১২ হাজার ৪৯৮টি।
মুলতবি বা চলমান মামলা রয়েছে থানার (জিআর) দুই হাজার ৪১৬টি, সিআর (আদালত) মামলা চার হাজার ৮৯৭টি। এর মধ্যে ১২২৭টি হত্যা মামলা।
ঢাকা পোস্ট : চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তি চ্যালেঞ্জিং বটে, সেটা কীভাবে করছে পিবিআই?
বনজ কুমার মজুমদার : এই মুহূর্তে পুলিশের হেফাজতে সিলেটে যুবকের মৃত্যুর মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। এছাড়া নোয়াখালীর নারী নির্যাতনের মামলা, রংপুরে এক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় স্পেশাল (বিশেষ) নজর দিতে হয়। বাইরের ইউনিট ও এক্সপার্টদের (বিশেষজ্ঞ) সহযোগিতা নিতে হয়। আমরা এক্সপার্ট অফিসারদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেই। সেমিনার করি। কেস স্টাডি করি, আশপাশের ২০/২৫ জন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়ে। সেখানে নানা আঙ্গিক থেকে প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রশ্ন করার সক্ষমতা বাড়ে কর্মকর্তাদের। এখন এসব আমাদের খুব কাজে দিচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষায় পিবিআই’র সক্ষমতা মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?
দেখুন, আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করি। একটা টিম হিসেবে কাজ করি। নুসরাত হত্যা মামলা তদন্তে আমরা ১০টি ইউনিট একযোগে কাজ করেছি। এটা আমাদের চালিকাশক্তি।
বনজ কুমার মজুমদার
ডিআইজি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত, আমাদের মাত্র ১৮০০ জনবল। সাব-ইন্সপেক্টর ৩১১ জন, ইন্সপেক্টর ৪৭০ জন। এর মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা হচ্ছেন এসআই পর্যায়ের ২৭০ জন, ইন্সপেক্টর পর্যায়ের ৩৬৮ জন। এখন জনবল বাড়ছে। আইজিপি মহোদয় খুব আস্থার সঙ্গে পিবিআইকে জনবল দিতে চেয়েছেন। এবার পেয়েছি ১০০ জন।
মানুষ চায় আস্থার জায়গা। দেশীয় কালচারে আমাদের কিছু সমস্যা আছে, প্রভাব বা প্রভাবিত করার চেষ্টা। সেটা কাটিয়েই পিবিআই আস্থার জায়গাটা নিতে চায়। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। নারীবান্ধব তদন্ত সংস্থা হতে যা যা করা প্রয়োজন পিবিআই তা-ই করে যাচ্ছে।
বিপদে প্রতিটি মানুষ যেন পিবিআইকে পাশে পায়, আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। কিছু ভুলত্রুটি যে আমাদের হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তবে সার্বিক মূল্যায়নের জায়গা থেকে বলতে পারি, কাজের কারণেই মানুষ পিবিআই’র ওপর আস্থা রাখছে, আদালতও আস্থা রাখছে, প্রশংসা করছে।
জেইউ/এমএআর