আমলাতন্ত্রের মধ্যেই দেশ— এটা অস্বীকারের উপায় নেই
আমলাতন্ত্রের মধ্যেই দেশ— এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারাই ক্ষমতায় ছিল, মূলত তারাই দেশটাকে আমলানির্ভর করে ফেলেছে। দীর্ঘদিন আমলানির্ভর থাকায় তাদের ভীত এখন অনেক গভীরে। এ কারণে আওয়ামী লীগ চাইলেই পুরোপুরি রাষ্ট্রক্ষমতা রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দিতে পারে না। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে এখনও আমলাদের প্রভাব অনেক বেশি...
মাহবুবউল-আলম হানিফ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টানা চারবারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জানান দেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে হয়েছেন পৈতৃক জেলা কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্রের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তুলে ধরেন দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও কথা বলেন খোলামেলা। তিনি বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক সফলতা দেখালেও ‘মানবিক’ উন্নয়নে এক যুগ পরও কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেখাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তিন পর্বের সাজানো আলাপচারিতার দ্বিতীয়টি আজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। আলাপচারিতায় ছিলেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমানউল্লাহ আমান।
আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এটাকে অন্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা কারও মুখাপেক্ষী নই
মাহবুবউল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
ঢাকা পোস্ট : অভিযোগ রয়েছে, সরকার আমলানির্ভর হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী?
মাহবুবউল-আলম হানিফ : আমলাতন্ত্রের মধ্যেই দেশ— এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় ছিল, সেই সামরিক সরকার জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে, এরশাদ থেকে শুরু করে প্রত্যেকেই কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তারা দেশটাকে তাদের সরকারি আমলাদের দিয়েই পরিচালিত করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এ দলগুলো আমলানির্ভর হওয়ায় আমাদের দেশে আমলাতন্ত্র অনেক বড় শক্ত ভীত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেটা হয়তো আওয়ামী লীগ চাইলেও পুরোপুরি ভেঙে একেবারে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দিতে পারবে না। সেটা করাও সম্ভব হয়নি। তাই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে এখনও আমলাদের প্রভাব অনেক বেশি।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমান সরকার চীনের দিকে ঝুঁকছে বলে একটা প্রচার রয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মাহবুবউল-আলম হানিফ : এটা যারা বলে তারা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বলে। সরকারকে কোনো একটা দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা বা কোনো একটা দেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক— এগুলোকে ইন্ডিকেট করে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কটা যাতে নষ্ট হয়, সেজন্যই এ ধরনের প্রোপাগান্ডা করা হয়। আওয়ামী লীগ সবসময় জাতির পিতার প্রদর্শিত যে বৈদেশিক নীতি, সেটাকে অনুসরণ করে আসছে।
আমরা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কার সঙ্গে সম্পর্ক করলাম, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো— এটার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, এমন তুলনার প্রশ্নই ওঠে না
মাহবুবউল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবেই যে আদর্শ বা নীতি প্রণয়ন করেছিলেন, ‘সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, কারও সঙ্গে কোনো বৈরিতা নয়’, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বেশি গভীর ও দৃঢ় হবে এবং সেটাই যৌক্তিক। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে আমাদের তিন-চতুর্থাংশ সীমানা। এ সীমানা নিয়ে, ভারতের সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি— সবকিছুরই একটা গভীর মিল আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কে ফাটল ধরানোর জন্য অনেকেই প্রোপাগান্ডা চালায়।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশে আসার জন্য আমাদের অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে। আমাদের রাস্তা- ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট থেকে শুরু করে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে হয়েছে। বড় বড় মেগা প্রজেক্ট আমাদের সরকারকেই করতে হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশে মাইলফলক হিসেবে থাকবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, আমাদের পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, আমাদের ঢাকার মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র— এসব মেগা প্রজেক্টগুলো বাংলাদেশের জন্য একেকটা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। ব্যাপকভাবে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার জন্য উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে যখনই যে দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, আমরা তাদের সাদরে গ্রহণ করেছি। আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এটাকে অন্যভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা কারও মুখাপেক্ষী নই।
ভারত আমাদের বন্ধু, আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি বিশ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে খাবার দিয়েছিল, সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, আমাদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল। এমনকি শেষদিকের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি অংশ নিয়েছিল এবং এখানে তাদের অনেক সৈন্য প্রাণ দিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যদের রক্তে এ মাটি রঞ্জিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক, এ সম্পর্ক তো অন্যকিছু দিয়ে পরিমাপ করার সুযোগ নেই। আমরা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কার সঙ্গে সম্পর্ক করলাম, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো— এটার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, এমন তুলনার প্রশ্নই ওঠে না।
ঢাকা পোস্ট : করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে জটিলতা, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড— এসব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
মাহবুবউল-আলম হানিফ : ভারতের সঙ্গে আমাদের তিন-চতুর্থাংশ সীমান্ত। স্বাভাবিকভাবেই অনেক সময় ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটে। দুই দেশের এই ইস্যুগুলো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি। দুই দেশের সরকারই সমানভাবে আন্তরিক যে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে। আমরা আশা করছি, সীমান্তে হত্যা এখন যতটুকু শোনা যায় একেবারেই কমে এসেছে, নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে সেটুকুও ভবিষ্যতে থাকবে না।
আমেরিকা বা অন্যকোনো দেশে কোন সরকার আসল বা গেল, বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমেরিকায় নতুন একটা সরকার আসলেই যে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা যারা ভাবে তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করে
মাহবুবউল-আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
ভ্যাকসিনের বিষয়ে আমাদের দেশের একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তারা ভারতের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরামের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এখানে চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাকসিনটা আসবে, কোনো সমস্যা নেই। যেটা হয়েছে ভারতে, তাদের (সরকার) সঙ্গে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একটা চুক্তি আছে, ভারতে ১০ কোটি ডোজ দেওয়ার পরই তারা (সেরাম) অন্য দেশে পাঠাতে পারবে। ভারতে ১১০ কোটি মানুষ। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডোজ বানানো হয়ে গেছে। এখন বাকি ৫০ কোটি ডোজ উৎপাদন হলেই বাংলাদেশে পাঠাতে পারবে। হয়তো কিছুদিন সময় লাগতে পারে।
ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না, তা কিন্তু নয়। ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে, যথাসময়েই আসবে। আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে ভুল প্রচারণার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যখন চুক্তি হয়েছে, মনে করেছে হয়তো সেদিন থেকেই ভ্যাকসিন আসবে। একটা চুক্তি হলেই যে সঙ্গে সঙ্গে সেটা আসবে, তা নয়। তারা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, তাদের হয়তো আরও অনেক চুক্তি আছে। সব চুক্তিই তারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অনুসরণ করবে।
ঢাকা পোস্ট : ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নিচ্ছেন। এর কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কি-না?
মাহবুবউল-আলম হানিফ : প্রত্যেকটা দেশেরই একটা নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি আছে। সেই পররাষ্ট্রনীতির আলোকেই কিন্তু তারা বহির্বিশ্বের সঙ্গে কী সম্পর্ক থাকবে, সেটা নির্ধারণ করে। পররাষ্ট্রনীতিগুলো তাদের মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়। এটা যে সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব ব্যাপক আকারে পরিবর্তন হয়, সে রকম নয়। বাংলাদেশে, এখানে আমেরিকার নতুন সরকার আসলে তাদের পররাষ্ট্রনীতির যে পরিবর্তন হবে, এ ধরনের কোনো আভাস কিন্তু নাই। সেটা সময় বলে দেবে, কী হবে, না হবে।
কিন্তু আমাদের জন্য কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক এই যে আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল তারা সবসময় বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেশের জনগণের ওপর তাদের আস্থা নেই। যারা জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারে না, তারাই বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা মনে করে, কোনো সরকার পরিবর্তন হলে হয়তো এ সরকারের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবে।
একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলি, আমেরিকা বা অন্যকোনো দেশে কোন সরকার আসল বা গেল, বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমেরিকায় নতুন একটা সরকার আসলেই যে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা যারা ভাবে তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করে। জনগণের ওপর আস্থা নেই বলেই তারা এসব স্বপ্ন দেখে তৃপ্ত থাকতে চায়। (চলবে)
এইউএ/এমএআর