মৃত মানুষও সরকারি টাকা তোলেন!
সরকারি ফান্ডের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি নতুন নয়। অর্থ আত্মসাৎ করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়। কিন্তু মৃত মানুষকে জীবিত দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, তাও পুলিশ সুপারের জাল সইয়ের মাধ্যমে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে!
বাংলাদেশ পুলিশের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) ও নিরাপত্তা জামানতের (ডিপোজিট অ্যাগেইনস্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড সাপ্লাই) থেকে এ প্রক্রিয়ায় প্রায় নয় কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। ঘটনাস্থল মাগুরা জেলা।
বিভিন্ন ব্যক্তির নামে চেক ও জাল সই ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসছিল চক্রটি। যেখানে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য, জেলা হিসাবরক্ষক ও সোনালী ব্যাংক মাগুরা শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
যাদের চেক ব্যবহার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ‘মৃত’ ও ‘অবসরপ্রাপ্তদের’ নামও রয়েছে
পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও দেখা গেছে, বিগত চার বছরে কয়েকটি হিসাব ব্যবহার করে প্রায় নয় কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে।
অনুসন্ধান কর্মকর্তা সব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে অপরাধী কারা, তারা কোন কোন ব্যক্তির ব্যাংকহিসাব ব্যবহার করেছেন এবং তাদের সহযোগী কারা
নাজমুস সাদাত, উপ-পরিচালক, দুদক
দুটি অভিযোগে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের জিপিএফ ও নিরাপত্তা জামানত নামের দুটি তহবিল থেকে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হিসাব জেলা পুলিশের তিন সদস্যের নামে। সন্দেহভাজন ওই তিনজন হলেন- জেলা পুলিশের কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমান, মো. ফিরোজ হোসেন ও শিপন মৃধা। এর মধ্যে গাজী মসিউর রহমান পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে ক্যাশ সরকার (পুলিশ সদস্যদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য বিল–ভাউচার জমা দেওয়া ও উত্তোলনের কাজ করেন) হিসেবে জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিযুক্ত ছিলেন।
ফিরোজ হোসেন পুলিশ সুপার কার্যালয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া শিপন মৃধা মসিউর রহমানের আত্মীয়। বাকি দুটি হিসাব হলো- মো. আজমল মুন্সী ও রুকাইয়া ইয়াসমিন বিচিত্রার নামে। এর মধ্যে মো. আজমল মুন্সী নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। একই এলাকায় বাড়ি কনস্টেবল গাজী মসিউর রহমানের। রুকাইয়া ইয়াসমিন বিচিত্রা মাগুরা পৌর এলাকার সাজিয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা। অভিযোগে ১৫টি চেক উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। অনেকগুলোতে চেকের তথ্য ও অ্যাডভাইসের তথ্যে অমিল রয়েছে। আর যাদের চেক ব্যবহার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ‘মৃত’ ও ‘অবসরপ্রাপ্তদের’ নামও রয়েছে।
বিষয়টি নজরে আসে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর এক পুলিশ সদস্যের চেকের দুটি পাতা হারিয়ে যাওয়ার পর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুলিশের কনস্টেবল মসিউর রহমান চেকের দুটি পাতা সরিয়ে ফেলেন। পরে ওই দুটি ছাড়াও অনুরূপ ১৫টি চেকের সন্ধান পাওয়া যায়।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র বলছে, মো. আজমল মুন্সীর নামেই পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। মাগুরা সোনালী ব্যাংকে হিসাবটি খোলা হয় ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। হিসাবে পরিচয়দানকারী হিসেবে আছেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. মনিবুর রহমানের নাম। ওই কর্মকর্তার সই জাল করেই হিসাবটি খোলা হয়। সবমিলিয়ে গত চার বছরে ভুয়া কয়েকটি হিসাবে নয় কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বিগত চার বছরে প্রায় নয় কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি জিডি করা হয় দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে
এসব ঘটনা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক, যশোরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন। অনুসন্ধানে নেমে এরই মধ্যে জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় এবং পুলিশের পাঁচ থেকে সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধানের তথ্য যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এছাড়া আত্মসাতের অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছে দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা নাজমুস সাদাত বলেন, এ ঘটনায় মাগুরা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং মাগুরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে দুটি জিডি করা হয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধানের অনুমতি পাওয়া গেছে।
‘অনুসন্ধান কর্মকর্তা সব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে অপরাধী কারা, তারা কোন কোন ব্যক্তির ব্যাংকহিসাব ব্যবহার করেছেন এবং তাদের সহযোগী কারা।’
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, যে ১৫টি চেক উদ্ধার হয়েছে, তার অনেকগুলোতে তথ্য ও অ্যাডভাইসের তথ্যে মিল নাই। সেক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে এগুলো ফেরত পাঠানোর কথা। তবে তা করা হয়নি। পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে ম্যানুয়ালি বিল দেওয়ার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে অনলাইনে বিল পাঠানো হয়েছে। চেক চুরি করে, স্বাক্ষর জাল করে, অডিটরদের (নিরীক্ষক) কম্পিউটারের ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড হ্যাক করার প্রমাণও মিলেছে।
এ বিষয়ে মাগুরা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বক্তব্য হচ্ছে, গত ২ ডিসেম্বর পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সূত্রে দেখা যায়, মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে জিপিএফ ও নিরাপত্তা জামানত ফান্ড থেকে ওই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। যার সঙ্গে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তিন সদস্য জড়িত আছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়ায় পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে বিল দাখিল হওয়ার পর জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয়ে যায়।
এরপর কয়েক দফা যাচাই–বাছাই শেষে অর্থ নির্দিষ্ট হিসাবে জমা হয়। কিন্তু দেখা যায়, ওই চেকগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে কোনো বিল দাখিল করা হয়নি। এর সঙ্গে পুলিশের অসাধু কিছু সদস্যের পাশাপাশি জেলা হিসাবরক্ষণ ও ফিন্যান্স কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্ঘবদ্ধ একটি চক্র জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরএম/এমএআর/