দেশজুড়ে আলো ছড়াচ্ছে ‘বীজ এসএমই’
সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা সরিষার বীজ দিয়ে তিন বিঘা জমিতে আবাদ করে ১২ হাজার টাকা মুনাফা করতে হিমশিম খেতে হতো কৃষক ফেরদৌস ফকিরকে। বর্তমানে একই পরিমাণ জমিতে তিনি মুনাফা করছেন ৪৫ হাজার টাকার ওপরে।
এছাড়া নিজের নামের পাশে ‘বীজ উদ্যোক্তা’র সরকারি একটি সনদও মিলেছে তার। মানসম্মত বীজ সরবরাহ করে নিজ এলাকার কৃষকের আবাদের ফলন ও মুনাফা বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তিনি। মাত্র চার মাস সময়ে ফসল আবাদে ভালো মুনাফার পাশাপাশি এমন ‘অর্জনে’ খুশি তরুণ কৃষক ফেরদৌস ফকির।
সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোফরেখী গ্রামের ফেরদৌস ফকিরের মতো সাড়ে চার হাজার কৃষক ডাল, তেল ও মসলা জাতীয় ১৮টি ফসলের মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ করে দেশজুড়ে আলো ছড়াচ্ছেন। এতে নিজে যেমন আলোকিত হচ্ছেন, তেমনি আলোকিত করছেন চারপাশের কৃষককে।
এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে- মসুর, মুগ, মাসকালাই, খেসারি, ফেলন, অড়হড়, সরিষা, তিল, সয়াবিন, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ, আদা, ধনিয়া ও কালোজিরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর আগেও সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি করা প্রায় ৮০ ভাগ বীজ দিয়ে এসব ফসল আবাদের বিকল্প ছিল না। বর্তমানে ‘বীজ এসএমই’ (ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা) উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে শতভাগ উন্নত মানের বীজ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগের মহাপরিচালক (বীজ) বলাই কৃষ্ণ হাজরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শতভাগ উন্নতমানের বীজ ব্যবহার নিশ্চিত হলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ০.৫ থেকে ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফসল উৎপাদন বেশি হবে। শতকরা হিসাবে আমরা বলতে পারি ২০ শতাংশ ফলন বাড়বে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা বলেন, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা করে দেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে ডাল, তেল ও মসলাজাতীয় ফসলের বীজ উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে। যেন শতভাগ মানসম্মত বীজ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এতে দেশের ফসল উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ী হিসেবে লাভবান হবেন কৃষকরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলার বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের মাধ্যমে দেশজুড়ে ওই ১৮টি ফসলের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহে এ সফলতা মিলছে। পাঁচ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৩৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শেষ হবে আগামী ২০২২ সালের জুন মাসে।
‘বীজ এসএমই’র প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ খায়রুল আলম প্রিন্স প্রকল্পের শুরু থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘শুরুতেই যে সফলতা এসেছে, বিষয়টি এমন নয়। কৃষকদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ, উপকরণসহ সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা দেশজুড়ে উদ্যোক্তা তৈরি করেছি। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এসব কৃষককে বীজ বিক্রির ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছে।’
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার ছোট কালিয়াকৈর গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন। গত দুই বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করেছেন। কিশোর বয়স থেকে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত জসিম বলেন, ‘প্রথম বছর ছয় বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করে মুনাফা হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। পরের বছর ১৬ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করি। ৭৫ টাকা কেজি দরে ২০ মণ বীজ বিক্রি করি। এখান থেকে ৬০ হাজার টাকা আসে। অবশিষ্ট সরিষা এক লাখ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করি। পাশাপাশি নিজের পরিবারের তেলের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে। ১৬ বিঘা জমিতে আমার খরচ হয়েছে ৭০ হাজার টাকার মতো।’
প্রকল্পের উপ-পরিচালক ড. ফ. ম. মাহবুবুর রহমান বলেন, কৃষকদের আমরা হাতে-কলমে শিখিয়ে দক্ষ করে তুলেছি। যেন প্রকল্পটি শেষ হলেও কার্যক্রম চলমান থাকে। কীভাবে ফলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক লাভবান হওয়া যায়, সেই কৌশলও শেখানো হয়েছে। ফলে এর সুফলের পরিধি শুধু বাড়তেই থাকবে। বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন— তিনটি বিষয়েই দক্ষতার সঙ্গে আলো ছড়াতে থাকবেন কৃষকরা।
একে/জেডএস