হল-মার্ক কলঙ্কের ভার বইছে দুদক!
সোনালী ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি ৪১টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত হল-মার্ক নামে এক অখ্যাত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। এরপর কেলেঙ্কারি উন্মোচনের গুরুদায়িত্ব পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওপর।
দীর্ঘ আট বছর ধরে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান ও তদন্তের ভার এখনও বয়ে চলছে সংস্থাটি। অনেক বিতর্ক পেরিয়ে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ফান্ডের মোট এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলায় ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে সক্ষম হলেও বিচারিক রায় এসেছে মাত্র একটি মামলায়।
অন্যদিকে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চলছে আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারি নন-ফান্ডেড (আসল ও সুদসহ) ১৭০০ কোটি টাকা লোপাটের অনুসন্ধান। মাঝে নন-ফান্ডেড অংশের দুটি মামলা হলেও অনুসন্ধানের খুব বেশি অগ্রগতি নেই।
লোপাট হওয়া টাকার মধ্যে হল-মার্ক গ্রুপের কাছ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোপাট হওয়া আসল দুই হাজার ৮৮০ কোটি টাকা এখনও অনাদায়ী। যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন রূপসী বাংলা শাখায় করা মাদার এলসির বিপরীতে দেওয়া ঋণের যাবতীয় ভার সরকারি ওই ব্যাংকটি ওপর পড়েছে। অর্থাৎ ঋণের পুরো টাকাই এখন ফান্ডেড (সরাসরি সোনালী ব্যাংকের দায়)। যদিও কেলেঙ্কারির সঙ্গে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে প্রায় ৪১টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের শতাধিক শাখার জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে দুদকের হাতে।
তারপরও ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল অজ্ঞাত কারণে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির এ অংশের দুর্নীতি অনুসন্ধান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। যার স্মারক নং- দুদক/বি. অনু. ও তদন্ত-১/মানিলন্ডারিং/৩২-২০১২(অংশ-৫)/১০৩১২। বিভিন্ন বিতর্ক ও পর্যালোচনার পর সোনালী ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টের সূত্র ধরে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুদক পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে আট সদস্যের টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার টিম গঠন ও পুনর্গঠন হয়েছে। সর্বশেষ পুনর্গঠিত টিমের সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক এস এম আক্তার হামিদ ভূঁইয়া, মশিউর রহমান ও সেলিনা আক্তার মনি, সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সিলভিয়া ফেরদৌস এবং উপ-সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও আফনান জান্নাত কেয়া।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘হল-মার্কের নন-ফান্ডেড অংশ অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের পরিচালক মীর মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। যদিও এটিকে নন-ফান্ডেড বলা হয়েছিল, কিন্তু এর পুরোটাই ফান্ডেড। ইতোপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশন এ অংশের ওপরে মামলাও দায়ের করেছিল। নতুন টিম অনুসন্ধান শেষ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেবে।’
সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন রূপসী বাংলা শাখায় জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হলে অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৪ সালে ফান্ডেড মোট এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় দুদক। তবে নন-ফান্ডেড প্রায় এক হাজার ৭১০ কোটি টাকার দুর্নীতি অনুসন্ধান এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। দীর্ঘ ছয় বছর বিরতির পর হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় নন-ফান্ডেড অংশের মানিলন্ডারিং আইনে প্রথম মামলা দায়ের হয় ২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর। মামলায় ঢাকা ব্যাংকের ১৪টি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি হিসাবে সন্দেহজনকভাবে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা হস্তান্তর এবং স্থানান্তর করার দায়ে হল-মার্কের গ্রুপের এমডি তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (জিএম-কমার্শিয়াল) তুষার আহমেদ, এক সময়ের জিএম মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন ও তুষার আহমেদের আত্মীয় সুমন ভূইয়ার নামে মামলা করা হয়।
দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক জালিয়াতির ঘটনায় নন-ফান্ডেড দ্বিতীয় মামলা হয় ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এক কোটি নয় লাখ ৬৬ হাজার ৭৬১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। হাজারীবাগ থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক সেলিনা আকতার মনি। মামলায় আসামি করা হয় সোনালী ব্যাংকের বরখাস্ত হওয়া এজিএম সাইফুল হাসান, ভেনারেবল এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দীন সেলিম, এমডি সঞ্জীবন রায়, ড্রেস মি ফ্যাশনের চেয়ারম্যান জিনাত ফাতেমা, এমডি তাওহীদ হোসেন ও পরিচালক তসলিম হাসানকে।
এদিকে সোনালী ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ব্যাংকটির কাছে (নন-ফান্ডেড) অন্তত ৩৫টি বেসরকারি ব্যাংকের প্রকৃত পাওনা প্রায় এক হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮৯২ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ অন্যান্য ব্যাংকের এলসি বিলবাবদ পরিশোধ করে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সোনালী ব্যাংকের হিসাব থেকেই এ টাকা পরিশোধ করা হয়।
অন্যদিকে দুদকের কার্যক্রম ও সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগে এখন পর্যন্ত হল-মার্ক গ্রুপের কাছ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১ মামলা এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ফান্ডেড প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আরও ২৭ মামলা দায়ের করে দুদক।
পরবর্তী সময়ে ফান্ডেড মোট এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ৩৮ মামলার চার্জশিট দেয় সংস্থাটি। যেখানে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। যেখানে হল-মার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা ও গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ এবং হল-মার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্তাদের আসামি করা হয়।
দুদকের দায়ের করা মামলার মধ্যে মাত্র একটির বিচারিক রায় হয়েছে। ওই মামলায় হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৬ সালের ২৪ মে ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালত এ রায় দেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— হল-মার্ক গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্যারাগন নিট কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম রাজা, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও সোনালী ব্যাংকের হোটেল রূপসী বাংলার কর্মকর্তা সাইফুল হাসান। আসামিদের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় দুই কোটি ২২ লাখ ৭৮ হাজার ৬১০ টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক নাজমুচ্ছাদাত ২০১৩ সালের ২৮ মে ঢাকার রমনা থানায় মামলাটি করেন।
হল-মার্ক গ্রুপের মোট কারখানার সংখ্যা প্রায় ৪৩টি। এর মধ্যে ২১টিকে ঘিরেই সোনালী ব্যাংকের সব পাওনা রয়েছে। এগুলো হলো— হল-মার্ক ফ্যাশন, হল-মার্ক ডিজাইন ওয়্যার, ওয়াল মাট ফ্যাশন, ইসলাম ফ্যাশন, ডন অ্যাপারেল, ফারহান ফ্যাশন, মাহমুদ অ্যাপারেল, হল-মার্ক স্পিনিং, ববি ফ্যাশন, হল-মার্ক ডেনিম কম্পোজিট, ববি ফ্লাট বেড প্রিন্টিং, হল-মার্ক এক্সেসরিজ, হল-মার্ক নিট কম্পোজিট, ববি ডেনিম কম্পোজিট, হল-মার্ক স্টাইল, পারফেক্ট এমব্রয়ডারি, হল-মার্ক প্যাকেজিং, জিসান নিট কম্পোজিট, হল-মার্ক নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, আনোয়ার স্পিনিং ও ম্যাক্স স্পিনিং। শেষের দুটি কারখানা মূলত হল-মার্কের সৃষ্টি করা বেনামি প্রতিষ্ঠান। ওই দুটি কারখানার বিপরীতে প্রাপ্ত দেনা আদায়ে দেওয়ানি আদালতে মানিস্যুট (অর্থঋণ) মামলা করা হয়েছে।
আরএম/এসএম