স্ট্রোক : সাড়ে ৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা নিলে সুস্থতার সম্ভাবনা বহুগুণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) স্ট্রোকের রোগীদের সর্বাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কারও মধ্যে স্ট্রোকের লক্ষণ দেখার সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা নিলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। তাই স্ট্রোকের লক্ষণ জেনে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব বিএসএমএমইউয়ের মতো স্ট্রোক রেডি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে হবে।
রোববার (১৬ অক্টোবর) বিএসএমএমইউয়ে স্ট্রোকের কারণ ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে অনুষ্ঠিত মাসিক সেন্ট্রাল সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্ট্রোকের রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারলে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তবে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাককে এক ভেবে কালক্ষেপণ করায় মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ ঘণ্টাই জরুরি বিভাগে স্ট্রোকের রোগীদের জরুরি সেবা দেওয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়া আমাদের হাসপাতালে রোগীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই আমাদের মতো স্ট্রোকের রোগীদের সেবার জন্য সকল মেডিকেল কলেজে ২৪ ঘণ্টাই স্ট্রোকের রোগীদের সেবা দেওয়া যায় এমন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
>> ৯০ ভাগ স্ট্রোকই প্রতিরোধ সম্ভব
সেমিনারে বলা হয়, ‘টাইম ইজ ব্রেইন’ স্ট্রোকের পর প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি সময় যাবে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্যরালাইসিস, বিকলাঙ্গতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি বেড়ে যায়। স্ট্রোকের চিকিৎসায় সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরও বলা হয়, মস্তিষ্কের যে অংশে রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয় সেখানে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে স্ট্রোকের লক্ষণগুলো দেখা যায়। একইভাবে স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যায়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের খুবই ভয়ঙ্কর অসুখ। হার্ট অ্যাটাকের মতোই স্ট্রোকের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। এ কারণেই স্ট্রোককে ব্রেইন অ্যাটাক বলে। স্ট্রোকে রোগীর প্রতি মিনিটে ১৯ লাখ কোষ মারা যায় এবং তা অনিরাময়যোগ্য।
স্ট্রোকের প্রকারভেদ ও লক্ষণ
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, স্ট্রোক মূলত দুই প্রকার- ও হেমোরহেজিক স্ট্রোক। ইসকেমিক স্ট্রোকের (রক্ত জমাট বাধা) মধ্যে বেশির ভাগ ট্রাকই রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেধে রক্ত চলাচল গিয়ে ইসকেমিক স্ট্রোক হয়ে থাকে। হার্ট অ্যাটাক যেমন হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে, ইসকেমিক স্ট্রোক মস্তিষ্কে না রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাধার কারণে হয়ে থাকে। দুভাবে ইসকেমিক স্ট্রোক হতে পারে। হৃদপিণ্ড থেকে জমাটবদ্ধ রক্ত ছুটে গিয়ে মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ করে দেয়। এছাড়াও মস্তিষ্কের রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী সরু হয়ে গিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

আর হেমোরহেজিক স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লে তাকে হেমোরহেজিক স্ট্রোক বলে। যেসব কারণে হেমোরহেজিক স্ট্রোক হয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো- উচ্চ রক্তচাপ ও মস্তিষ্কের রক্তনালীর দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া। সাময়িকভাবে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হলে তাকে ট্রানসিডেন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক বলা হয়। এ ধরনের স্ট্রোক সাধারণত কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে ট্রানসিডেন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক হওয়ার পর স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
সেমিনারে আরও বলা হয়, প্রথমেই মনে রাখতে হবে, একজন রোগী স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্ট্রোকের লক্ষণ ও সেগুলো শরীরের কোন অংশে আক্রান্ত করবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে তার ওপরে। তবে স্ট্রোকের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। স্ট্রোকের লক্ষণ সহজে বোঝার জন্য মুখ একদিকে বাঁকা, হাত বা পায়ের দুর্বলতা, কথার অস্পষ্টতা ও এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।
স্ট্রোকের কিছু ঝুঁকির কারণ
স্ট্রোকের কিছু ঝুঁকির কারণ আছে যা পরিবর্তন করা যাবে না, যেমন- বয়স, পারিবারিক ও মেডিকেল ইতিবৃত্ত। কিন্তু শতকরা ৮০ ভাগের ক্ষেত্রেই স্ট্রোকের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যে বিষয়গুলো আপনার নিয়ন্ত্রণে তা হলো- উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪ গুণ বেড়ে যায়। নিয়মিত শরীরচর্চা, অল্প লবণযুক্ত খাবার ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিয়মিত সেবনের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
কোলেস্টেরলের মাত্রা অধিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চর্বিযুক্ত খাবার অনেকাংশে দায়ী। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোলেস্টেরলের ওষুধ নিয়মিত সেবনের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানো সম্ভব। ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অন্যান্য রোগসহ স্ট্রোকের ঝুঁকি দেড় গুণ বাড়িয়ে দেয়। সুস্থ জীবনধারা, ডায়াবেটিসের ওষুধের নিয়মমাফিক সেবন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি দেড় থেকে আড়াই গুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ধূমপান ছাড়া গেলে পাঁচ বছরের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি অধূমপায়ীর সমান হবে।
>> ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় যেসব অভ্যাস
স্থূলতা স্ট্রোকের পাশাপাশি অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্ট্রোকের ধরনের ওপর নির্ভর করে স্ট্রোকের বিভিন্ন রকম চিকিৎসা করা হয়। রক্ত জমাট বেঁধে ইসকেমিক স্ট্রোক হলে ওষুধের মাধ্যমে জমাটবদ্ধ রক্ত গলিয়ে দিয়ে যে চিকিৎসা করা হয় তা প্রয়োলাইসিস নামে পরিচিত। এছাড়াও ইসকেমিক স্ট্রোকে জমাটবদ্ধ রক্ত নিউরো ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে বের করে আনা হয় যা প্রজেক্টমি নামে পরিচিত। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে হেমোরহেজিক স্ট্রোক হলে নিউরো সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সবুজ, অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম। সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন বিএসএমএমইউয়ের সেন্ট্রাল সাব কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সহকারী অধ্যাপক ডা. সম্প্রীতি ইসলাম।
টিআই/ওএফ