শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে হাসপাতালে

>> শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
>> শিশুদের মাথায় অতিরিক্ত তেল না মাখানোর পরামর্শ
>> খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মমাফিক চলাফেরার পরামর্শ
শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগও। রাজধানীসহ সারাদেশের নানা প্রান্ত থেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন অনেকেই। মৌসুমি এসব রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। তাছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগেও দেখা গেছে রোগীদের লম্বা সারি। এসব রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা, ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরাও। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের বাড়তি চাপতো রয়েছেই।
তবে এসব রোগ থেকে বাঁচতে খাদ্যভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রেখে নিয়মমাফিক চলাফেরা করার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সরেজমিন ঘুরে এবং রোগী, চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে লিভারজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকা ভোলার হারুন আর রশিদ গত রোববার চিকিৎসার জন্য আসেন ঢাকা মেডিকেলে। রোগীর স্বজন মো. আলামিন বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসা হচ্ছে না। করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য ঘুরছি। তিনদিন সময় লাগবে বলল, অথচ রোগীর অবস্থা ভালো না।’
রাজধানী হাজারীবাগ থেকে তিন মাসের শিশুকে নিয়ে আসা এক মা বলেন, ‘আমার বাচ্চার কোনো সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করে পাঁচ দিন হলো খুব ঠান্ডা লেগেছে। ডাক্তার দেখালাম। পরামর্শ ও ওষুধ লিখে দিল। আবার দুদিন পরে আসতে বলেছেন।’
রংপুর থেকে মেয়েকে নিয়ে আসেন মোস্তফা মিয়া। গত তিন বছর ধরে মেয়ের গলায় ব্যথা। শীতে ব্যথার তীব্রতা বেড়েছে, সকালে হাসপাতালে এলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত চিকিৎসককে দেখাতে পারেননি। তাই অপেক্ষা করছেন বহির্বিভাগে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করাবেন বলে জানান তিনি।
শীতের জন্য কিছুটা রোগী বাড়ছে। আমরা সকাল ৭টা থেকেই টিকিট দেওয়া শুরু করি। ডাক্তার বসেন ৮টায়। চলে ২টা পর্যন্ত। শীতজনিত নানারকম সমস্যা নিয়ে এখন রোগীরা ভিড় করছেন।
ঢামেক হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা জুয়েল খান

শিশুদের ঠান্ডাজনিত সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ রাজেশ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ সময়ে পাঁচ বছরের নিচে শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের বিষয়ে একটু সাবধানে থাকতে হবে। বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। একদিন বা দুদিন পরপর গোসল করানো ভালো। পায়ে মোজা, মাথায় গরম টুপি পরাতে হবে। শিশুরা গরম কাপড় খুলে ফেলে দেয়, গায়ে রাখতে চায় না এ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে।’
দেখা গেছে, মায়েরা শিশুদের মাথায় অতিরিক্ত তেল মাথায় মেখে রাখেন, এটা ঠিক না। অতিরিক্ত তেল মাথায় দিলে তেল জমে থাকার কারণে সহজে আরও বেশি ঠান্ডা লাগে। তাই শিশুদের গায়ে তেল ব্যবহারে মায়েদের আরও সচেতন থাকা জরুরি। শীতের এ সিজনে বাচ্চাদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার্শ্ববর্তী চিকিৎসকে দেখাতে হবে।
ডা. রাজেশ মজুমদার
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে মায়েরা সাবধানে থাকতে হবে। বাচ্চাদের খাবারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে বাচ্চাকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর, এর কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে মাকে বেশি বেশি খেতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী শীতে সবাইকে একটু বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ অতিমাত্রায় বেড়েছে। বায়ু দূষণের ফলে বাইরের ধুলাবালি আমাদের শরীরে ঢুকছে প্রতিনিয়ত। শীতের এ প্রকোপে নানা কারণে মানুষের শরীরে রোগ বাড়বে এবং বাড়ছে। বিশেষ করে এ সময়ে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন এবং তারাই শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে সবার জন্য পরামর্শ হলো, প্রথমতো বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। সবসময় গরম কাপড় পরিধান করতে হবে, গরম কাপড় পরিধান ছাড়া বের হওয়া যাবে না। সময়ে করে প্রতিদিন রোদ পোয়াতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে ঘোরাফেরা করা যাবে না।’
ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে শীতে বাজারে অনেক শাক-সবজি পাওয়া যায়। শাক-সবজির খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। সেসব খাবার শরীরে সহনীয় এসব খেতে হবে। যেমন- ভিটামিন সি রয়েছে এমন খাবার কমলা, লেবু প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।’ তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাসহ হালকা কুসুম গরম পানি পান করার পরামর্শও দেন তিনি।
দেশে করোনা পরিস্থিতি
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো সাত হাজার ৫৩১ জনে। একই সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও এক হাজার ২৩৫ জন। এর মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ১২ হাজার ৪৯৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
এ পর্যন্ত দেশে মোট চার লাখ ৫৬ হাজার ৭০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টাতেই সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৫০৭ জন।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি
সর্বশেষ পাওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩৮৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার ৩৫৭ জন ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ডেঙ্গু সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) এসেছে। আইইডিসিআর চারটি ঘটনার পর্যালোচনা শেষ করে তিনটি মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত বলে নিশ্চিত করেছে।
কবির হোসেন/এফআর