বাবা-মায়ের দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া নতুন প্রজন্মের বিকাশ অসম্ভব

বাবা-মায়ের দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া নতুন প্রজন্মের বিকাশ অসম্ভব বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য ও মানসিক বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলেও মত দিয়েছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর খেলনা, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিভাইস শিশুর মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে এবং সেটি অনেক সময় বাবা-মার জ্ঞানের পরিধিকে ছাড়িয়ে যায়। তাই নিজেদের নতুন প্রযুক্তির শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে সন্তানদের সঠিক পথ দেখানো সম্ভব নয়।
রোববার (১৬ মে) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘প্যারেন্টিং: অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকরা এমন মতামত দেন।
তারা বলেন, সন্তান লালন-পালন বাবা-মায়ের যৌথ দায়িত্ব, মাকেই এক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে এ ধরনের পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কর্মজীবী মায়েদের ব্যাপারে স্বামী, পরিবার, এমনকি রাষ্ট্রকে অনেক বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। পরিবার ও সমাজের চাপে অনেক কর্মজীবী মা একটা সময় পর কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন যা পরিবার তথা দেশের অর্থনীতির চাকা সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের পরিচালনায় এতে আলোচনায় অংশ নেন অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের সাবেক পরিচালক (জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. ইন্দিরা চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ এবং মনোবিজ্ঞানী ডা. তাসদিক হাসান দ্বীপ।
আলোচনার শুরুতেই প্রফেসর ইন্দিরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম এবং এর উদ্যোক্তাকে এরকম একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দিনদিন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি বাচ্চাদের আইকিউ লেভেল বাড়ছে। কর্মজীবী মায়েরা অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মায়েদের চেয়ে বাচ্চাদের বেশি সময় দিয়ে থাকেন কেননা তারা সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকেন চাকরির জন্য তারা বাচ্চাদের যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন কি না। অনেক ক্ষেত্রে তারা আলাদাভাবে বিনোদনের সুযোগ গ্রহণ না করে সে সময়টা বাচ্চাদের সঙ্গে কাটান।
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে মন্তব্য করে ড. নাজনীন বলেন, অনেক কর্মজীবী নারী-ই সন্তান জন্মের পর তার দেখভালের জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ মেয়েদের মাথায় কাজ করে এ দায়িত্ব শুধুই মায়েদের, বাবাদের নয়। মেয়েরা এখন সর্বস্তরের কর্মক্ষেত্রে আসছে এটা যেমন সত্য, তেমনি তারা সন্তানদের সময় না দিতে পারা নিয়ে এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগেন।
নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে করে ডা. তাসদিক বলেন, প্যারেন্টিং শুধু মার দায়িত্ব নয়। এটা একটা টিমওয়ার্ক হওয়া উচিত। আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে বাচ্চারা যথাসময়ে কথা বলতে বা সঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না অথবা অন্য কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এসবের পেছনে অন্যতম কারণ ‘স্ক্রিন এডিকশান’। কারণ বাচ্চাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ন থাকছে মোবাইল বা ট্যাব। ট্যাবে তারা হয়ত ইংরেজি কিছু দেখছে কিন্তু বাসার লোকজন বাংলায় কথা বলছে, আবার দেশের বাইরে থাকা লোকজন অন্যভাবে কথা বলছে। সবমিলিয়ে বাচ্চারা মানিয়ে নিতে পারছে না। বাবা কিংবা মা অথবা উভয়ের যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে তার প্রভাব সরাসরি সন্তানের ওপর পড়ে। সন্তান সুইসাইড করা, মাদকাসক্ত হওয়া ইত্যাদির পেছনে প্যারেন্টিং এর প্রভাব খুব বেশি। বাচ্চাদের বেশি সময় দেওয়ার চেয়ে কোয়ালিটি সময় দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেসর ইন্দিরার পর্যবেক্ষণ, বাচ্চারা এখন সমবয়সীদের সঙ্গে না খেলে শুধু খেলনা নিয়েই খেলতে পছন্দ করে, খেলনাই ওদের অগ্রাধিকার। বিভিন্ন রকম প্রযুক্তিনির্ভর খেলায় তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে করে বাচ্চাদের মধ্যে পারস্পরিক শেয়ারিং কমে যাচ্ছে। তাদের আইকিউ বাড়ছে, কিন্তু অ্যাটাচমেন্ট কমছে, ফিজিক্যাল কন্টাক হচ্ছে না।
ড. নাজনীন গার্মেন্টস শ্রমিক নারীদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা ইচ্ছে করেই সুপারভাইজার (উচ্চ পদে) কাজ করতে চান না কারণ সেক্ষেত্রে তারা তাদের সন্তানদের বেশি সময় দিতে পারবেন না। খুব ছোটবেলায় বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক থেকেই বাচ্চারা শিখে যে সন্তান লালন-পালন করা মায়েদের কাজ আর অর্থ উপার্জন করা বাবাদের কাজ। কর্মজীবী বাবা-মার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ স্থাপন করা উচিত।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বাচ্চাদের চাইলেও এগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যায় না, বরং নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মন্তব্য করে ডা. তাসদিক বলেন, বাচ্চাদের হাতে ডিভাইস থাকলে তারা কোন সাইটে ঢুকছে, কি গেমস খেলছে সেদিকে বাবা-মাকে নজর দিতে হবে। কারণ বাচ্চা কোনো সাইটে ঢুকে কোনো অপরাধে জড়িত হয় তা বোঝা মুশকিল। বাচ্চাদের কোনো অভিযোগ বা কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতাকেই হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এমনকি বাবা-মারও মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে যার প্রভাব সন্তানদের ওপর পড়তে পারে। সন্তান লালন-পালন বাবা-মায়ের যৌথ দায়িত্ব। মাকেই এক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে এ ধরনের পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ মা-বাবা উভয়কেই দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হবে। মা কর্মজীবী হোক বা না হোক পরিবারের সবাই মাকে সাপোর্ট করতে হবে।
ড. নাজনীন বলেন, গার্হস্থ্য অর্থনীতি শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিষয় হতে পারে না। দেশে কোনো ছেলে শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না যে এই বিষয়ে পড়েছে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিসহ সন্তান লালন-পালনের যুগোপযোগী চ্যালেঞ্জ সবার পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে প্রত্যেকের জন্য প্যারেন্টিং নামে একটি চ্যাপ্টার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
টিআই/জেডএস