ভাষা-ধর্মীয় বিশ্বাসের বাধায় পাহাড়ে ‘চিকিৎসাবঞ্চিত’ প্রবীণরা

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা জাতিসত্তার সদস্যরা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলেও সময়মতো চিকিৎসা পান না। সরকারি সেবাদান ব্যর্থতার পাশাপাশি বড় তিনটি কারণে এই প্রবীণদের চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে- ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, আধুনিক চিকিৎসার প্রতি অবিশ্বাস এবং প্রথাগত ও ধর্মীয় ট্যাবু। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোগান্তি বাড়ছে পাহাড়ের প্রবীণদের।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ-সংশ্লিষ্ট আচরণ বিষয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডা. রাজন তালুকদার।
গবেষণায় উঠে আসে, সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশিরভাগই বাঙালি এবং তারা স্থানীয় মারমা, চাকমা কিংবা ত্রিপুরা ভাষা বোঝেন না।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, বহু প্রবীণ স্থানীয় ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না। ফলে রোগের উপসর্গ বা চিকিৎসার ধরন ব্যাখ্যা করতে না পারায় সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন তারা। একইসঙ্গে অনেক প্রবীণ এখনো আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে প্রথাগত উপায়ে যেমন- ঝাড়ফুঁক, ভেষজ পাতা, গাছের ছাল ইত্যাদির ওপর নির্ভর করেন। তাদের বিশ্বাস, আধুনিক ওষুধ শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে প্রথাগত পদ্ধতির চর্চা “শুদ্ধ” বলে বিবেচিত হয়।
এছাড়াও ওইসব অঞ্চলের প্রবীণদের অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন বলেও গবেষণায় জানা গেছে। বিশেষ করে নারী প্রবীণরা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে রোগ বলতে সংকোচবোধ করেন। অনেকসময় পরিবার থেকেও উৎসাহ দেওয়া হয় না, বরং তাদের রোগ ‘কর্মফল’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
গবেষণা প্রসঙ্গে ডা. রাজন তালুকদার বলেন, সারাবিশ্বে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক রোগ। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে রয়েছে এইসব অসংক্রামক রোগ। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রবীণরা অন্যদের তুলনায় এই সকল রোগে বেশি ভুগলেও গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যান। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ-সংশ্লিষ্ট আচরণ বিষয়ে জানা প্রয়োজন।
তিনি জানান, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণসংশ্লিষ্ট আচরণ মূলত তিন ধরণের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বলে গবেণায় জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা বাংলায় যোগাযোগ করেন বলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রবীণরা ভাষাগত বাধার মুখোমুখি হন এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলে প্রবীণরা সেখানে যেতে চান না।
সুপারিশে এই অবস্থার উত্তোরণে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা জানা স্থানীয়দেরকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীদেরকে উৎসাহিত করা উচিৎ যেন তারা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার সময় প্রবীণদেরকে সঙ্গ দেন এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সেবা পেতে অপেক্ষার সময় কমিয়ে ও ওষুধের মূল্য কমিয়ে আনাসহ বেশকিছু সুপারিশ করেন গবেষণা প্রধান ডা. রাজন তালুকদার।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখেই এমন স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি গড়ে তুলতে হবে, যা ট্যাবু ভেঙে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে মায়েদের উদ্বুদ্ধ করবে।
ট্যাবু দূর না হলে অপুষ্টি দূর হবে না উল্লেখ করে ডা. শাহিনুল আলম আরও বলেন, একজন গর্ভবতী নারীর খাবার শুধু তার নিজের জন্য নয়, একটি নতুন প্রাণের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয়। দেশে ৫৪টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আনুমানিক ১৬ লাখ সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মু, সাঁওতাল, খাসি, গারো, বম, হাজং এবং মণিপুরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রতি বছর ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী দিবস’ পালিত হয়। এই দিনের গুরুত্বকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের উদ্যোগে আজকের এই সেমিনার ও গবেষণার ফলাফল প্রকাশের আয়োজন।
পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হকের সভাপতিত্বে ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার, নিপসম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউল ইসলাম।
টিআই/এমএসএ