ভিন্ন প্যানেলে ভোট দেওয়ায় পরীক্ষককে হুমকি, চিকিৎসকদের পরীক্ষা স্থগিত

বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন শেষ হলেও এর রেশ যেন কাটছেই না। অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচনে ভিন্ন প্যানেলকে ভোট দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) এক চিকিৎসক পরীক্ষাকেন্দ্রে হুমকি ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)–এর শীর্ষ ড্যাব নেতা এবং সদ্য বিজয়ী ডা. হারুন–শাকিল প্যানেলের সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরদিনের (১২ আগস্ট) ডিপ্লোমা ইন অর্থোপেডিক্সের (ডি-অর্থো) নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করে, যা চিকিৎসক সমাজে বিরল ও নজিরবিহীন বলে আলোচিত হচ্ছে। তবে অভিযুক্ত ড্যাব নেতা অভিযোগ অস্বীকার করে একে ‘বিরোধী পক্ষের সাজানো ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে বিএমইউ–এর অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ডি-অর্থো পরীক্ষক হিসেবে নিটোর হাসপাতালে পৌঁছান। পরীক্ষা চলাকালে নিটোর ড্যাব শাখার সভাপতি ডা. শামসুল আলম একাধিকবার এসে তার সঙ্গে তর্কে জড়ান। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের একপর্যায়ে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনি আগামীকাল এখানে পরীক্ষা নিতে আসবেন না, এলে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হবে।’
লিখিত অভিযোগ হেনস্থার শিকার ডা. আশরাফুলের
পরীক্ষা শেষে কেন্দ্র থেকে ফিরে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। অভিযোগে ডা. আশরাফুল জানান, ১১ আগস্ট নিটোরে ডি-অর্থো পরীক্ষা নিতে গেলে ড্যাব নিটোর শাখার সভাপতি ডা. শামসুল আলম আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনি ভোটটি ওই প্যানেলে দিয়েছেন, কাজটি ভালো করেননি।’
পরীক্ষা চলাকালীন কিছুক্ষণ পর ডা. শামসুল আবারও এসে বলেন, ‘আপনার এত বড় সাহস হয়েছে এখানে পরীক্ষা নিতে এসেছেন, আগামীকাল আর আসবেন না। যদি আসেন, আপনাকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হবে।’

অভিযোগে আরও বলা হয়, এই হুমকি তিনি অন্য সব পরীক্ষক ও রেজিস্ট্রারদের সামনে দেন। প্রতিবাদ করলে ডা. শামসুল আমার দিকে আবারও তেড়ে আসেন এবং আপত্তিকর ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে ডা. আশরাফুল।
পরের দিনের পরীক্ষা স্থগিত করল বিশ্ববিদ্যালয়
পরীক্ষা কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট একজন পরীক্ষককে হুমকি ও শারীরিক হেনস্থার অভিযোগ আসার পর বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ (১২ আগস্ট) নিটোরের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য ডিপ্লোমা ইন অর্থোপেডিক্স (ডি-অর্থো) পরীক্ষা স্থগিত করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ডা. মো. জিললুর রহমান স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, যেহেতু পরীক্ষককে হুমকি ও হেনস্থার অভিযোগ গুরুতর, তাই নির্ধারিত পরীক্ষা আয়োজন করা অনুকূল নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষাগুলো স্থগিত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে।

পরীক্ষার পরিবর্তিত তারিখ ও সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পরবর্তী সময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
যা বলছেন ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল
বিএমইউ’র রেজিস্ট্রারের কাছে দেওয়া অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে প্রথমে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। পরে একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি একচুয়ালি যাদের কাছে অভিযোগ করছি, তাদের সামনেই বিষয়টি বলতে চাই। আমি এর বাইরে অন্য কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’
বিষয়টি তো এখন আর ব্যাক্তিগত নেই, আপনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এটা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী— এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আশরাফুল বলেন, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ব্যাপার, তারা এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করুক। আমার অভিযোগ সত্য না মিথ্যা, সেটাই দেখুক তারা।’
আরও পড়ুন
ড্যাবের নতুন নির্বাচিত হওয়া সভাপতি বলেছেন তিনি আপনাকে চেনেন না, এমনকি আপনি কোনোদিন ড্যাব করেননি— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি (ড্যাব সভাপতি) আমাকে পার্সোনালি না-ও চিনতে পারেন। কিন্তু তিনি কি ড্যাবের ভোট দিতে আসা তিন হাজার মেম্বারকে চেনেন? কিন্তু যাদের ভোট পেয়েছেন, তাদের সবাইকে নিশ্চয়ই চিনবেন। তাই আমাকে না চেনাটাই স্বাভাবিক। সবাই কী এত পলিটিক্যাল হয়? সবাই কী পার্টি অফিসে যায়?’
যাদের বিরুদ্ধে তার হুমকি-হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে, তাদের সঙ্গে তার কোনো পূর্ব শত্রুতা বা দ্বন্দ্ব ছিল না বলে জানান ডা. আশরাফুল। তিনি বলেন, ‘ওনার বা ওনাদের কারও সঙ্গেই আমার পূর্বের কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না। বিষয়টি পুরোপুরি নির্বাচনকেন্দ্রিক এবং আমাদের (ড্যাবের) অভ্যন্তরীণ সমস্যা।’
এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডা. মিজানুর রহমান নামে আরেক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পরীক্ষার হলে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, দাবি অভিযুক্ত ড্যাব নেতার
ড্যাব নিটোর শাখার সভাপতি ডা. শামসুল আলম দাবি করেছেন, এটি একটি মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ। গত ৯ আগস্টের নির্বাচনে জয়ের পর প্রতিপক্ষ গ্রুপ আমাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় তারা একজনকে ব্যবহার করে একটি সাজানো অভিযোগ তৈরি করেছে। আপনি সেই পরীক্ষার হলে উপস্থিত অন্য পরীক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দেখতে পাবেন, সেদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, এটা শুধু আমাদের হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য করা হচ্ছে। সেদিন আমি ছাড়াও আরও তিনজন পরীক্ষক ছিলেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলে দেখুন।
ডা. আশরাফুলের সঙ্গে তার দেখা বা কথার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শামসুল বলেন, “সকালে পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় সম্ভবত তার সঙ্গে একবার চোখে-মুখে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় কোনো কথা হয়নি।”
পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজ শুনেছি পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে। যতটুকু জানি আগামীকাল থেকে আবার পরীক্ষা শুরু হবে। আমার মনে হয় না এ ঘটনায় পরীক্ষা বন্ধ হওয়া উচিত ছিল। তবে তারা যা করেছে, আমি আর কী বলব?

হেনস্থার শিকার চিকিৎসককে ‘স্বাচিপের লাইফ মেম্বার’ দাবি অভিযুক্তের
ডা. আশরাফুলকে ড্যাবের সদস্য হিসেবে নয় বরং স্বাচিপের লোক হিসেবে অভিহিত করেছেন অভিযুক্ত ডা. শামসুল। তিনি বলেন, আমরা জানি ডা. আশরাফুল স্বাচিপের লাইফ মেম্বার। তিনি দাবি করেন ড্যাবের লাইফ মেম্বার, কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে পিজিতে (বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চাকরি করছেন। শেখ হাসিনার সময় তিনি দুটি প্রমোশন পেয়েছেন, যতটুকু জানা যায় তিনি স্বাচিপের সঙ্গে মিশে প্রমোশন পেয়েছেন।
ডা. শামসুল আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে পিজিতে আমাদের ৬০০ ডাক্তার প্রমোশন পায়নি, তারা বঞ্চিত ছিল। কিন্তু উনি আগে প্রমোশন পেয়েছেন।
এটা কি কোনো ষড়যন্ত্র, তা খতিয়ে দেখা দরকার : কেন্দ্রীয় ড্যাব সভাপতি
অভিযোগ প্রসঙ্গে ড্যাবের নবনির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যতটুকু শুনেছি, মনে হচ্ছে বিষয়টি পরিকল্পিত। ভোট তো গোপন ব্যালটে হয়, কেউ আমাকে ভোট দেয়নি— এটার তো কোনো প্রমাণ থাকে না। তাহলে আপনি কী করে জানতে পারবেন, কে কোন প্যানেলকে ভোট দিয়েছে?
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, যদি কেউ আপনার প্যানেলের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য প্যানেলে কাজ করে, তাহলে সে তো সবার কাছে পরিচিত হবে। ডা. আশরাফুলের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় এমন কিছু হয়নি। তিনি ড্যাবের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত ছিলেন না এবং আমরা তাকে খুব সক্রিয় কখনো দেখিনি। সে নিজের মতো কাজ করেছে।
ডা. হারুন আল রশীদ বলেন, এই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে তাকে ব্যবহার করে কেউ কি এই অভিযোগ তুলিয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাকে যদি কেউ হুমকি দিত, তাহলে কেন সে হুমকি দেবে? সে তো খুবই ‘আন-ইম্পর্টেন্ট পারসন’। আমি দীর্ঘ সময় ধরে ড্যাবের প্রেসিডেন্ট, তাকে এখনো চিনি না। তিনি যে ড্যাবের সদস্য, এটা আমি প্রথম শুনলাম।
তিনি আরও বলেন, এটা কি কোনো ষড়যন্ত্র, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, ড্যাবের দুটি পক্ষ রয়েছে। একপক্ষ অন্য পক্ষকে অভিযুক্ত করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে পারে। আমি জানি না এটা সত্যিই এমন কিছু কিনা।
ডা. হারুন বলেন, যদি পরীক্ষা কেন্দ্রে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটে থাকে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক। আমি চাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অনুসন্ধান করুক, আপনাদেরও অনুসন্ধান করা উচিত। এরপর দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
টিআই/এমজে
