বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুগছেন মানসিক চাপে

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য একটি বড় মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিচ্ছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পরিচালিত সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪১.৯ শতাংশই সরাসরি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আর এ কারণে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, যা তাদের পড়াশোনা, সামাজিক জীবন এমনকি ভবিষ্যৎ কর্মজীবনকেও প্রভাবিত করছে।
শনিবার (৩০ আগস্ট ২০২৫) রাজধানীতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট জনাব সায়েদুল ইসলাম সাঈদ, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী জনাব হাবিবুর রহমান, পার্সপেক্টিভ-এর নির্বাহী সম্পাদক জনাব সিবগাতুল্লাহ সিবগা, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জনাব সোহেল মামুন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব তানসেন রোজ।
গবেষণায় অংশ নেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১,১৭৩ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিলেন ৫৬.৬ শতাংশ, পুরুষ ৪৩.১ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ০.৩ শতাংশ। বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে বড় অংশটি (৫৮.১ শতাংশ) ছিলেন ২৩ থেকে ২৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থী। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৪৯.৩ শতাংশ) ছিলেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯.৬ শতাংশ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শতাংশ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩.৪ শতাংশ এবং পলিটেকনিক শিক্ষার্থী ছিলেন ১.৬ শতাংশ।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাস জীবনে তারা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ দাবি করেছেন তারা পরীক্ষার ফলাফলে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের মতে, শিক্ষকের ব্যক্তিগত আবেগ বা পক্ষপাতমূলক আচরণ এখানে বড় ভূমিকা রাখে। প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন তারা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন। ১৯ শতাংশ ধর্মীয় কারণে, ৯ শতাংশ জাতিগত কারণে, ২৩ শতাংশ আর্থিক কারণে, ২৯ শতাংশ শারীরিক অবয়বের কারণে এবং ৩০ শতাংশ রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে শ্রেণিকক্ষে (৬০ শতাংশ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভেন্টে ৩৭ শতাংশ, হলে ১৯ শতাংশ, বন্ধুদের আড্ডায় ৩৮ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনে ১৮ শতাংশ এবং লাইব্রেরি ও ক্যাফের মতো জায়গাতেও বৈষম্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে শিক্ষার্থীদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নন। অংশগ্রহণকারীদের ৩১ শতাংশ জানান, তারা অনলাইনে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সহপাঠীদের দ্বারা, যা প্রায় ৫৮ শতাংশ। শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছেন ৫৫ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দায়ী করেছেন ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এমনকি ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও বৈষম্য করেন।
বৈষম্যের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। বৈষম্যের শিকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ জানিয়েছেন প্রভাব তাদের উপর গুরুতর, ৫১ শতাংশ বলেছেন মাঝারি প্রভাব পড়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণের কথাও জানিয়েছেন— ৫৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন, ৪৯ শতাংশ উদ্বিগ্নতা অনুভব করেছেন, ৩০ শতাংশ ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন, ২২ শতাংশ প্যানিক অ্যাটাকের শিকার, ৪৭ শতাংশ অতিরিক্ত চাপ অনুভব করেন, ৪৩ শতাংশ একাকিত্ব অনুভব করেন এবং ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী হীনমন্যতায় ভুগছেন।
এই মানসিক সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়ও বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে পারেন না। আর ৫১ শতাংশ ক্লাসে গেলেও পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হন।
অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। অন্যদিকে ৪৪ শতাংশ বলেছেন প্রশাসনের পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি, আর ১৭ শতাংশ মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই সহায়ক ভূমিকা নেয়নি।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের অনীহা রয়েছে। বৈষম্যের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের ৭৮ শতাংশ কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেননি। ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন তারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানেন না। ২৭ শতাংশ সামাজিক ট্যাবু বা লজ্জাকে বাধা মনে করেন। ৩৬ শতাংশ জানেন না কোথায় এই সেবা পাওয়া যায়। আর্থিক সমস্যাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ২৩ শতাংশ। তবে যারা সেবা নিয়েছেন (২২ শতাংশ), তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ জানিয়েছেন সমস্যা প্রশমিত হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। মাত্র ১৫ শতাংশ বলেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সেবা রয়েছে, আর ৭০ শতাংশ জানান পর্যাপ্ত সেবা নেই।
গবেষণা শেষে আঁচল ফাউন্ডেশন কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে— শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে নিয়মিত মেন্টরিং ব্যবস্থা করা, ছয় মাস অন্তর শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং করা, বৈষম্য ও হয়রানি প্রতিরোধে মনিটরিং টিম গঠন ও কঠোর আইন প্রয়োগ, প্রতিটি বিভাগে অভিযোগ বক্স রাখা এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কমপ্লেইন সেল গঠন, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করা এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চশিক্ষা অর্জনের সময় যদি শিক্ষার্থীরা বৈষম্য, অবহেলা এবং মানসিক চাপে জর্জরিত হন, তবে তা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়; বরং দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়নেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আঁচল ফাউন্ডেশন মনে করে, অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি, সচেতনতা এবং সহানুভূতিশীল ক্যাম্পাস সংস্কৃতি গড়ে তোলা ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
টিআই/এআইএস