কেন বাংলাদেশের জন্য ‘এক স্বাস্থ্য’ গল্পটি এখন জরুরি

আজ বিশ্ব যখন ‘এক স্বাস্থ্য দিবস’ উদযাপন করছে, তখন সময় এসেছে আমাদের বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোর গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য, পশুর স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য—এই তিনটিকে সংযুক্তকারী একটি একক, ভঙ্গুর সুতোকে স্বীকৃতি দেওয়ার।
এই ধারণাটি কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব নয়; এটি বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ব-দ্বীপাঞ্চলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবন রক্ষার কৌশল, যেখানে এই তিনটি জগৎ ক্রমাগত একে অপরের সাথে মিশে যায়।
একজন মিডিয়া ও কমিউনিকেশন পেশাজীবী হিসাবে আমি মনে করি, আসল চ্যালেঞ্জ সমস্যাটি নয়; বরং এর গল্প বলার ধরণ। আমাদের ‘এক স্বাস্থ্য’ নিয়ে আলোচনাকে প্রযুক্তিগত প্রতিবেদন থেকে নীতি-নির্ধারণী টেবিলে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সাধারণ মানুষের মন ও বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।
নীরব ঢেউ : সিরাজগঞ্জের আমিনার গল্পে ‘এক স্বাস্থ্য’
গত বছর সিরাজগঞ্জের এক গ্রামে দেখা হয়েছিল আমিনার সঙ্গে। তিনি একজন মা, ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারি, আর সেইসব নারীদের একজন, যারা নীরবে একেকটি সমাজকে টিকিয়ে রাখেন। ভোরের আলো ফুটতেই তিনি গরু দোহন করেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠান। পরিবারের পানির উৎস সেই একই পুকুর, যেখানে গরুর বর্জ্যও ফেলা হয়।
একটি গরুর কাশি, একটি শিশুর জ্বর, অথবা দূষিত সেই পানিই যেন এক পুরো পরিবারের জীবনে ঢেউ তোলে, নীরব কিন্তু বিপজ্জনক ঢেউ। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটাকেই বোঝাতে জন্ম হয়েছে ‘ওয়ান হেলথ’ ধারণার। এটি একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যা বলে মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীর স্বাস্থ্য ও পরিবেশের স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বিশ্বজুড়ে ও বাংলাদেশে বিপদ সংকেত
বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এর গুরুত্ব।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যান: বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর উদ্ভূত নতুন সংক্রামক রোগের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই প্রাণী উৎস থেকে আসে (জুনোটিক রোগ)। বার্ড ফ্লু থেকে কোভিড-১৯ পর্যন্ত সবকিছু এতে অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বব্যাংকের অনুমান, মহামারিগুলোর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হতে পারে।
জুনোটিক হুমকি: ২০০১ সাল থেকে দেশটিতে নিপাহ ভাইরাস একাধিকবার আঘাত হেনেছে। ২০২৩ সালের সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব দেখিয়েছে, কীভাবে একটি প্রাণীজ রোগ দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে দাপট দেখিয়েছে ডেঙ্গু। আর আজ আমরা লড়ছি অ্যানথ্রাক্স নামক মারাত্মক ব্যাধির সাথে, যা পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়।
নীরব সংকট: গবাদি পশু এবং জলজ চাষ খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ‘সুপারবাগ’ তৈরি করছে। এটি কেবল চিকিৎসা নয়, খাদ্য নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করছে।
এই বিষয়গুলো একটি সহজ সত্যকে তুলে ধরে। একটি অসুস্থ প্রাণী বা একটি দূষিত নদী একটি ব্যস্ত শহরের জন্য সরাসরি হুমকি।
নীতি-নির্ধারণী টেবিলে মিডিয়ার দায়িত্ব
‘এক স্বাস্থ্য’ থিমটিকে বিশেষায়িত সম্মেলনগুলোর একটি ছোট বিষয় না রেখে, এটিকে জাতীয় নীতির অগ্রাধিকার করা আবশ্যক। মিডিয়া এই পরিবর্তনকে চালনা করার ক্ষমতা রাখে।
সাংবাদিকদের কেবল রোগ বা মহামারির রিপোর্ট করার বাইরে যেতে হবে। স্বাস্থ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে একই টেবিলে বসার জন্য জনদাবিকে তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে মিডিয়ার উচিত সফলতার গল্পগুলো তুলে ধরা।
যখন একজন সাংবাদিক দেখাতে পারেন কীভাবে একটি কারখানার বর্জ্য, মৃত গবাদি পশু ও পানিবাহিত ডায়রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আছে, তখন নীতিনির্ধারকরা বাধ্য হন প্রতিক্রিয়া জানাতে। মিডিয়া শুধু খবরই দেয় না, নীতিনির্ধারণেও দিক নির্দেশ করে।
করণীয়: সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য
করণীয় বিষয়গুলো এখন বাস্তবসম্মতভাবে ও সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। পশু, মানুষ ও পরিবেশের স্বাস্থ্য তথ্য একত্র করলে দ্রুত সতর্কতা ও প্রতিরোধ সম্ভব।
টিকাদান, ঠান্ডা চেইন ও সহজলভ্য ভেটেরিনারি পরামর্শ প্রয়োজন।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ ও খামারি এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ জরুরি।
স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে পরিকল্পনা ও অর্থায়ন করতে হবে।
ব্যক্তিগত ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
নীতি পরিবর্তন শুরু হয় তৃণমূল পর্যায় থেকে। সচেতনতা বৃদ্ধির সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো সমস্যাটিকে মানবীয় করে তোলা। নিয়মিত হাত ধোয়া, খাবার ভালোভাবে রান্না করা এবং অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া বা দিতে বলা থেকে বিরত থাকা।
একজন ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য বার্তাটি সহজ— সুস্থ প্রাণী মানে সুস্থ পরিবার এবং নিশ্চিত আয়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বিনিয়োগের চেয়ে বহুগুণ সাশ্রয়ী। ওয়ান হেলথে বিনিয়োগ মানে একসঙ্গে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জীবিকা ও অর্থনীতি রক্ষা করা।
সিরাজগঞ্জের সেই সকালে, আমিনা বলেছিলেন, “গরুগুলো ভালো থাকলে, আমার বাচ্চারাও ভালো খায়, আর আমি একটু সঞ্চয় করতে পারি।” এই কথাটিই ওয়ান হেলথ-এর মূল দর্শন—প্রাণী, মানুষ ও পরিবেশের সুস্থতাই একে অপরের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে। আমরা যদি আরও মানবিক গল্প বলি, নীতিতে সমন্বয় আনি, আর মাঠের মানুষকে শক্তি দিই, তাহলে ওয়ান হেলথ শুধু একটি দিবস নয়, হবে আমাদের টেকসই জীবনের পথচলা।
লেখক : আব্দুল্লাহ সেরু
যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ