ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ রোগী, প্রস্তুতির ঘাটতিতে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য খাত

দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। বিদায়ের প্রহর গুনছে আলোচিত বছর ২০২৫। রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও নানা ঘটনায় শেষ হতে যাওয়া বছরটি দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। বছরজুড়ে ডেঙ্গু ছিল দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে চার শতাধিক মানুষের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি হতে পারে, কারণ সব রোগী ও মৃত্যুর তথ্য জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
এ বছর ডেঙ্গুর বিস্তার, সময়কাল এবং তীব্রতা– সব দিকই ছিল আগের বছরগুলোর চেয়ে ভিন্ন। আগের মতো বর্ষা মৌসুমে সীমাবদ্ধ না থেকে ডেঙ্গু বছরজুড়েই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এতে ডেঙ্গু মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, সমন্বয় ও পরিকল্পনায় মৌলিক ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ১ লাখ ২ হাজার ৮২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। সেইসঙ্গে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরে এযাবৎ ডেঙ্গুতে ৪১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আগের বছর ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। তার আগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

প্রাণহানির ভার রাজধানীতেই
চলতি বছর ডেঙ্গুতে সারা দেশে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তার অর্ধেকের বেশি ঢাকার দুই সিটিতে। শুধু রাজধানীতেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন আড়াইশর বেশি মানুষ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী। তবে আউটডোরে চিকিৎসা নেওয়া কিংবা বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের কোনো পরিসংখ্যান নেই, যা প্রকৃত পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বরফখণ্ডের চূড়া মাত্র; প্রকৃত সংক্রমণ এর কয়েকগুণ বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ১৬,৮৯৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১৪,৫১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকায় ১৭,৩০৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১৪,৮৮৭, বরিশালে ২১,৪৭০ ও খুলনায় ৫,৪৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে ৫,৮২৫, সিলেটে ৪২৩, ময়মনসিংহে ৪,২৬৭ ও রংপুরে ১,০৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।
মৃত্যুর হিসাবেও ঢাকা শহরই শীর্ষে। ডিএসসিসি এলাকায় এখন পর্যন্ত ১৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায় মৃত্যু হয়েছে ৬৮ জনের। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৩১, বরিশালে ৫০, খুলনায় ১৩, রাজশাহীতে ২০, সিলেটে ২, ময়মনসিংহে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে রংপুর থেকে মৃত্যুর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

নগরপিতাহীন প্রশাসন ও কার্যক্রমের স্থবিরতা
২০২৫ সালজুড়ে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ছিল কাগজে-কলমে পরিকল্পনা আর বাস্তবে ব্যর্থতার গল্প। প্রায় ১৬ মাস ধরে নগরপিতাহীন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন প্রশাসকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে প্রশাসক বদল হয়েছে ছয়বার। নেতৃত্বের এই অনিশ্চয়তা ও ধারাবাহিকতার অভাব সরাসরি প্রভাব ফেলেছে নগর ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায়। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধনের কাজ চললেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো বড় প্রকল্প কিংবা সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা দেখা যায়নি। ফলাফল হিসেবে ২০২৫ সালেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো সাফল্য আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে আরও দুর্বল করেছে। গত ২৭ মার্চ আদালত দক্ষিণ সিটির আগের নির্বাচনের ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন। ২৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করলেও শপথ না দেওয়াকে কেন্দ্র করে তার সমর্থকরা আন্দোলনে নামেন। টানা ৪৩ দিন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকে। এ সময়ে পরিচ্ছন্নতা, মশা নিধন, ড্রেন পরিষ্কারসহ প্রায় সব নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়। নগরের বড় অংশ কার্যত অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে, যার প্রভাব পড়ে ডেঙ্গু সংক্রমণে।
একইসঙ্গে প্রশাসকভিত্তিক পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি, দায়বদ্ধতার ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতা ডেঙ্গু মোকাবিলাকে আরও দুরূহ করে তোলে।

মৌসুমি রোগের ধারণা ভেঙে সারা বছর ডেঙ্গু
এতদিন ডেঙ্গুকে বর্ষাকেন্দ্রিক রোগ হিসেবে দেখা হলেও সেই ধারণা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। জানুয়ারি থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। বর্ষা শুরু হওয়ার পর সংক্রমণ দ্রুত বাড়ে কিন্তু বর্ষা শেষ হওয়ার পরও তা কমেনি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর– এই তিন মাসে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এমনকি ডিসেম্বরেও হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হতে দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, সাধারণত যে সময় ডেঙ্গু কমে যাওয়ার কথা, সেই সময়েই চলতি বছর সংক্রমণ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, দীর্ঘসময় উষ্ণ আবহাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং নগর পরিবেশে পানি জমে থাকার প্রবণতাকে দায়ী করছেন। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এসব কারণে এডিস মশার প্রজননকাল দীর্ঘ হয়েছে এবং ডেঙ্গু কার্যত সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে।
ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে উঠে বরগুনা, নিয়ন্ত্রণের বাইরে লার্ভা পরিস্থিতি
২০২৫ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে বরগুনা থেকে। বরগুনা এলাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এক জরিপে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, বরগুনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টি ওয়ার্ডই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে। এমনকি জেলা সদরে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় সাড়ে ৮ গুণ বেশি পাওয়া যায়। আইইডিসিআর জানায়, বরগুনায় ডেঙ্গুর ডেন-৩ ও ডেন-২ সেরোটাইপের প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাড়ছিল, যা সংক্রমণের তীব্রতা ও জটিলতার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।

গত ২৫ জুন সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন জানান, বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ ডেন-৩ ভ্যারিয়েন্টে এবং ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ ডেন-২ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। বাকি ১৪ শতাংশ রোগী ডেন-২ ও ডেন-৩ এর অন্যান্য ধরনে সংক্রমিত হয়েছেন। মোট ৪৩টি জিনোম পরীক্ষা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপে দেখা যায়, বরগুনা সদরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, এরপর পাথরঘাটা। তুলনামূলকভাবে কম রোগী শনাক্ত হয়েছে আমতলী ও বেতাগী উপজেলায়।
আইইডিসিআরের জরিপ দল বরগুনায় ১৮৪টি স্থানে লার্ভা পরীক্ষা করে যে চিত্র পেয়েছে, তা পরিস্থিতির গভীরতাই তুলে ধরে। সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে একক পৃথক বাড়িতে– ৫৬ শতাংশ। এরপর সেমি পাকা বাড়িতে ৩৩ শতাংশ, মাল্টিস্টোরেড ভবনে ৯ শতাংশ এবং নির্মাণাধীন ভবনে ২ শতাংশ। বরগুনা সদরে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ১৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পৌরসভা এলাকায় ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে একটি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ১৫৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, অন্যটিতে ১৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ– যেখানে মাত্র ৪টি ওয়ার্ডে এই সূচক ২০ এর নিচে।
হাসপাতালে রোগীর চাপ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র
ডেঙ্গু সংক্রমণের সরাসরি চাপ পড়েছে দেশের হাসপাতালগুলোতে। রাজধানী ঢাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রে একাধিক সময়ে শয্যা সংকট দেখা দেয়। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে দৈনিক কয়েকশ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়। অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড বাড়াতে হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল।

চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভর্তি হওয়া রোগীদের একটি বড় অংশই হাসপাতালে আসেন জটিল অবস্থায়। অনেক রোগী শুরুতে ভাইরাল জ্বর ভেবে বাড়িতে বা ফার্মেসিতে চিকিৎসা নিয়েছেন। সময়মতো পরীক্ষা না করানো এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত না হওয়ায় প্লাটিলেট বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যায়, লিভার ও কিডনির জটিলতা দেখা দেয়। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি আরও দুর্বল ছিল। প্রয়োজনীয় শয্যা, প্রশিক্ষিত জনবল ও পরীক্ষার সুবিধা না থাকায় বহু রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হয়, এতে রাজধানীর হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ আরও বেড়ে যায়।
মশা নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বাজেট : উদ্যোগ ও বাস্তবতা
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার হিসেবে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পর্যাপ্ত বাজেটসহ নেওয়া হলেও ২০২৫ সালে বাস্তবে তেমন ফল পাওয়া যায়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৫৩ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল, যা পরবর্তী বছর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৫৭ দশমিক ৪৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ১৩৫ দশমিক ৫ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়, যার ভেতর প্রায় ৮০ কোটি টাকা কীটনাশক কেনার জন্য নির্ধারণ করা হয়। এমনকি ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৯ কোটি টাকা বাজেট রাখলেও স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কার্যকর উদ্যোগ কম দেখা গেছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ অর্থের বড় অংশই কীটনাশক কেনা, ফগিং ইউনিট পরিচালনা ও স্প্রে সরঞ্জামে ব্যয় হয়। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরে মোটামুটি ৭০০ কোটি টাকার বেশি বাজেট মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হলেও এডিস মশার প্রকোপ কমেনি, এমনটাই দেখায় ২০২৫ সালের ডেঙ্গুর অব্যাহত সংক্রমণ। তবে নাগরিকরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান সচেতনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবেই অধিকাংশ এলাকায় মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মত, বাজেট থাকলেও পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে ২০২৫ সালের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ডেঙ্গু রোগের বিস্তার রোধে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে এবং ঘরোয়া পরিবেশে দমনমূলক অভিযান ছড়িয়ে না পড়ায় শহরের পাশাপাশি উপনগর ও গ্রামাঞ্চলেও ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
জনসচেতনতা, চিকিৎসা ব্যয় ও আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ২০২৫ সালে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ছিল সীমিত ও দেরিতে শুরু হওয়া। অধিকাংশ প্রচারণা শুরু হয়েছে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর। বার্তাগুলো ছিল সাধারণ ও একমুখী। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, বস্তি, শ্রমঘন অঞ্চল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ ছিল না বললেই চলে। ফলে সচেতনতার বার্তা আচরণগত পরিবর্তনে রূপ নিতে পারেনি।
ডেঙ্গু চিকিৎসা নিতে গিয়ে বহু পরিবার বড় আর্থিক চাপে পড়েছে। সরকারি হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অনেক রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। সেখানে আইসিইউ, পরীক্ষানিরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। কার্যকর স্বাস্থ্য বীমা বা আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় এই ব্যয় পুরোপুরি ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে।
২০২৫ সাল স্পষ্ট করে দিয়েছে, ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি সমস্যা নয়; এটি একটি স্থায়ী জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। আগাম সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তুতির ঘাটতি, দুর্বল সমন্বয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাপনার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিলে আগামী বছরগুলোতে ডেঙ্গু আরও বড় আকারে ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানান, ২০২৫ সালে ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল জায়গা ছিল পরিকল্পনার ভাঙাচোরা কাঠামো ও বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অভাব।
তিনি বলেন, ‘এ বছর মশা নিয়ন্ত্রণে যতটুকুই বাজেট ছিল, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হয়নি বলে আমি মনে করি। অর্থাৎ টাকা খরচের ধরন ছিল ভুল জায়গায়। ফগিং, স্প্রে ও কীটনাশক ছিটানো– এসব উদ্যোগ দৃশ্যমান, প্রচারণার জন্য আকর্ষণীয় কিন্তু সংক্রমণ কমাতে এর ভূমিকা সাময়িক। এডিস মশার জীবনচক্র থামাতে হলে লার্ভা ধ্বংস, পানি জমার উৎস বন্ধ, খাল-ড্রেন পুনরুদ্ধার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত বিনিয়োগ দরকার ছিল, যা হয়নি।’
অধ্যাপক হামিদ আরও বলেন, ‘নগর নেতৃত্বে ১৬ মাস ধরে মেয়র না থাকা, প্রশাসক বদলের উচ্চ হার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক জটিলতা বড় প্রভাব ফেলেছে। ছয়বার প্রশাসক পরিবর্তন মানে শুধু চেয়ার বদল নয়– প্রতিবার কাজের অগ্রাধিকার, টিমের নির্দেশনা, নজরদারি, এমনকি মশা নিয়ন্ত্রণ কৌশলও নতুন করে সাজাতে হয়েছে। এই দোলাচল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মতো স্থায়ী সংকট ব্যবস্থাপনায় বড় প্রতিবন্ধক।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যর্থতা ছিল বৈজ্ঞানিক নজরদারির দুর্বলতা। কোন এলাকায় হাউজ-ইনডেক্স, কন্টেইনার-ইনডেক্স বা লার্ভা-ইনডেক্স বাড়ছে, সেটি নিয়মিত ও প্রকাশ্য ডেটা হিসেবে আসেনি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাভিত্তিক লক্ষ্যভেদী অভিযান চালানো যায়নি।’
নতুন বছরে করণীয় তুলে ধরে অধ্যাপক হামিদ বলেন, ‘২০২৬ সালে ওয়ার্ডভিত্তিক লার্ভা জরিপ বাধ্যতামূলক করতে হবে, পানি জমার উৎসের বিরুদ্ধে আইনগত অভিযান জোরদার করতে হবে, খাল দখলমুক্ত ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পুনর্গঠনে দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনকে নিয়ে একটি স্থায়ী যৌথ অপারেশন সেল গঠন করতে হবে, যেখানে সিদ্ধান্ত হবে ডেটা নির্ভর ও সময় বেঁধে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে নগর পরিকল্পনার বাইরের ‘মৌসুমি কর্মসূচি’ হিসেবে দেখলে হবে না; এটিকে নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্থায়ী নীতি ও বাজেট কাঠামোর অংশ করতে হবে।’
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ২০২৫ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর উচ্চ হার স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো শহরকেন্দ্রিক ও কেন্দ্রীভূত কাঠামোর বাইরে বের হতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর মৃত্যু কমাতে হলে প্রথমেই চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। এখন প্রাথমিক থেকে জটিল– সব ধরনের রোগীর চাপ গিয়ে পড়ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বড় হাসপাতালগুলোতে। চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো হলেও রোগীর বেড, আইসিইউ সক্ষমতা বা নিবিড় পরিচর্যার সুযোগ সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে সংকটের সময় গুরুতর রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না। যে কয়টি আইসিইউ আছে, সেগুলোও সব রোগীর জন্য যথেষ্ট নয়।’
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অনেক রোগী ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে ভুগলেও পরীক্ষা করান না। আর যখন টেস্ট করান, ততক্ষণে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। হাসপাতালে গেলেই সিরিয়াল, দীর্ঘ অপেক্ষা, হয়রানি– এসব কারণে রোগীরা সময়মতো চিকিৎসা শুরু করতে পারেন না। বেশিরভাগ হাসপাতালের আউটডোর ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নেই, রোগীবান্ধব পরিবেশও অনুপস্থিত। এতে ডেঙ্গু শনাক্তে দেরি হচ্ছে, চিকিৎসা শুরুও বিলম্বিত হচ্ছে।’
নতুন বছরে করণীয় প্রসঙ্গে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শুধু মশা নিধন বা মৌসুমি সতর্কতা নয়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার পুনর্গঠনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জেলা হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় কার্যকর সক্ষমতা দিতে হবে। অন্তত ডেঙ্গু ডেডিকেটেড বেড, অক্সিজেন সাপোর্ট, আইসিইউ রেফারেল লিংক ও দ্রুত টেস্ট সুবিধা স্থানীয় পর্যায়ে নিশ্চিত না হলে মৃত্যুর হার কমানো যাবে না। রোগী হাসপাতালমুখী হওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রোগীর দোরগোড়ায় না পৌঁছাবে, ততক্ষণ ডেঙ্গুর মতো সংকটে সময়মতো প্রাণ বাঁচানো কঠিন হয়ে থাকবে।’
টিআই/এসএসএইচ
