টিকা ব্যবস্থাপনা: জনসমাগম রোধে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে জানুয়ারি মাসের ২১ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যেই দেশে ভ্যাকসিন আসবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই জাতীয়ভাবে এই টিকা দেওয়া শুরু হবে এবং প্রথম দফায় ৫০ লাখ মানুষ টিকা পাবেন।
আর এই টিকা ব্যবস্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা, উৎসুক জনতার ভিড় এবং অতিরিক্ত জনসমাগম রোধে কাজ করবেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সোমবার (১১ জানুয়ারি) বিকেল ৪টায় মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম এ তথ্য জানান।
টিকা ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করবেন। আমাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। টিকা ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো পর্যন্ত যে ধরনের নিরাপত্তা তারা দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, আমাদের দেশের বড় সমস্যা হলো, আমরা সবকিছুতেই একটু বেশি আগ্রহী। আমরা চিন্তা করছি যে, ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় তা দেখার জন্য ও নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত যে জনসমাগম হবে, তা রোধ করতে সেখানে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে।
এছাড়াও জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব, অতিরিক্ত ভিড় না জমানোর দায়িত্ব দেশের মিডিয়াগুলোকে নিতে হবে, যোগ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. শামসুল হক জানান, ভ্যাকসিন পরিবহন, সংরক্ষণ ও দেওয়ার সময় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক সহায়তা দেবে। ভ্যাকসিন বিষয়ক সরকারি প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয় সার্বিক দায়িত্ব পালন করবে।
কোথায় ভ্যাকসিন দেওয়া হবে?
ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলো হলো- উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা/সদর হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ-বিজিবি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল।
টিকা রাখার জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ইপিআই স্টোর রয়েছে, যেখানে ভ্যাকসিন রাখা হবে।
কারা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবে?
দেশে প্রথম দফায় ৫০ লাখ করোনা ভ্যাকসিনের টিকা দিতে কাজ করবেন সাত হাজার ৩৪৪ সদস্যের ভ্যাকসিন দল।
প্রতিটি দলে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য দুজন নার্স, সাকমো/পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা এবং তাদের সঙ্গে চারজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। রাজধানীসহ সারাদেশে ভ্যাকসিনেশন সেন্টারে তারা কাজ করবেন।
৫ সদস্যের ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম
টিকা ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম-২০২১’ গঠন করেছে সরকার।
টিমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (জনস্বাস্থ্য অধিশাখা) নীলুফার নাজনীনকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব আনজুমান আরাকে।
এছাড়াও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পাঁচ সদস্যের এই কমিটিতে সদস্য করা হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় ক্লিনিকের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মাসুদুর রহমান মোল্লা, জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ডিপিএম ডা. মফিজুল ইসলাম বুলবুলকে।
সুষ্ঠুভাবে করোনা টিকার ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর’বি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ এবং ভার্চুয়াল বৈঠক করবে এই কমিটি।
টিকা এবং কোভিড-১৯ সংক্রান্ত দেশ-বিদেশের সব তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে এই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমকে।
এই কমিটির নেওয়া কার্যক্রম ও অন্যান্য জরুরি বিষয়ে প্রতিদিন স্বাস্থ্য সচিবকে অবগতি করার পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। এবং প্রয়োজনে কমিটিতে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোরও এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
কীভাবে বিতরণ হবে টিকা
কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনা তুলে ধরে ডা. শামসুল হক জানান, তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে (১ম ডোজের ৮ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ) ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিকদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। কেউ যদি ২ ডোজ ভ্যাকসিন নিতে ইচ্ছুক হন তাকে অবশ্যই ডোজের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান নির্ধারিত ৮ সপ্তাহ দেশে অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে বৈধ কাগজপত্র (পাসপোর্ট, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি) দাখিল করতে হবে।
ভ্যাকসিন পরিবহন, সংরক্ষণ ও দেওয়ার সময়ে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক সহায়তা দেবে। ভ্যাকসিন বিষয়ক সরকারি প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে সাবির্ক দায়িত্ব পালন করবে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন নিবন্ধন, ভ্যাকসিন কার্ড, সম্মতিপত্র, ভ্যাকসিন সনদ দিতে আইসিটি বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর ‘সুরক্ষা ওয়েবসাইট’ প্রস্তুত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি ভ্যাকসিন পাওয়ার তালিকায় ফেজ-১ এর-এতে থাকছেন ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী। অর্থাৎ এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে কোডিভ-১৯ স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত সব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন। প্রথম মাসেই তারা ভ্যাকসিন পাবেন।
কোডিভ-১৯ স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি সম্পৃক্ত সব অনুমোদিত বেসরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৬ লাখ। প্রথম মাসেই তারা ভ্যাকসিন পাবেন। বীর মুক্তিযোদ্ধ ২ লাখ ১০ হাজার। তারাও প্রথম মাসে ভ্যাকসিন পাবেন। সম্মুখসারির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৬১৯ জন। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩১০ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক সদস্য ভ্যাকসিন পাবেন। সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন। প্রথম মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৫৭ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক সদস্য টিকা পাবেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য কার্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ হাজার। প্রথম মাসে পাবেন ২৫ হাজার এবং ২য় মাসে পাবেন ২৫ হাজার। সম্মুখসারির গণমাধ্যমকর্মী ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ২৫ হাজার এবং ২য় মাসে ২৫ হাজার ভ্যাকসিন পাবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন। প্রথম মাসে ৮৯ হাজার ১৪৯ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক জনপ্রতিনিধি ভ্যাকসিন পাবেন।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সম্মুখসারির কর্মচারী ১ লাখ ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ৭৫ হাজার এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক কর্মচারী ভ্যাকসিন পাবেন। ধর্মীয় প্রতিনিধির সংখ্যা ৫ লাখ ৪১ হাজার। ২য় মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ জন এবং ৫ম মাসে সমান সংখ্যক ধর্মীয় প্রতিনিধিররা ভ্যাকসিন পাবেন।
মৃতদেহ সৎকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি ৭৫ হাজার। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ৩৭ হাজার ৫০০ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ব্যক্তি ভ্যাকসিন পাবেন। জরুরি পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস ও পরিবহন কর্মচারী রয়েছেন চার লাখ। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ২ লাখ এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ভ্যাকসিন পাবেন।
স্থল, নৌ ও বিমান বন্দর কর্মী ১ লাখ ৫০ হাজার। প্রথম মাসে ৭৫ হাজার এবং ২য় মাসে ৭৫ হাজার ভ্যাকসিন পাবেন। প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিক ১ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে প্রথম মাসে ৬০ হাজার এবং ২য় মাসে সমাস সংখ্যক টিকা পাবেন।
জেলা ও উপজেলায় জরুরি জনসেবায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মচারী ৪ লাখের মধ্যে প্রথম মাসে ২ লাখ এবং ২য় মাসে ২ লাখ টিকা পাবেন। ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন। ২য় মাসে তাদের সবাইকে টিকা দেওয়া হবে।
স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জনগোষ্ঠী (যক্ষ্মা, এইডস রোগী, ক্যানসার রোগী) ৬ লাখ ২৫ হাজার। এদিকে ৮০ বছরের ওপরে ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন। এই বয়সের সবাই প্রথম মাসে ভ্যাকসিন পাবেন। ৭৭ থেকে ৭৯ বছরের ১১ লাখ ৩ হাজার ৬৫৩ জন। এই বয়সের জনগোষ্ঠীও প্রথম মাসে ভ্যাকসিন পাবেন।
৭৪ থেকে ৭৬ বছরের জনসংখ্যা ৯ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৩ জন। ২য় মাসে এই বয়সের সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। ৭০ থেকে ৭৩ বছরের জনসংখ্যা ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। ২য় মাসে এই বয়সের সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। ৬৭ থেকে ৬৯ বছরের জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার। ৫ম মাসে এই বয়সের ২২ লাখ ৪ হাজার ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। ৬৪ থেকে ৬৬ বছরের জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৭৫ হাজার। ৫ম মাসে এই বয়সের মানুষ টিকা পাবেন।
জাতীয় দলের খেলোয়াড় (ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদি) ২১ হাজার ৮৬৩ জন। প্রথম মাসে ১০ হাজার ৯৩২ জন এবং ২য় মাসে সমান সংখ্যক ভ্যাকসিন পাবেন।
বাফার, ইমার্জেন্সি ও আউটব্রেক প্রথম মাসে ৭০ হাজার, ২য় মাসে ৫০ হাজার এবং ৫ম মাসে ৫০ হাজার জন ভ্যাকসিন পাবেন।
মোট দেড় কোটি লোকের প্রথম মাসে ৫০ লাখ, ২য় মাসে ৫০ লাখ এবং ৫ম মাসে ৫০ লাখ টিকা পাচ্ছেন।
ডা. শামসুল হক বলেন, এছাড়াও আগামী মার্চ থেকে জুনের মধ্যে যেকোনো সময়ে কোভ্যাক্স থেকে টিকা চলে আসবে। এতে করে আরও মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা যাবে।
টিআই/জেডএস