ইরানে কুকুর-বিড়াল পুষলে জেলে যেতে হতে পারে, কিন্তু কেন?

ও ওর নিষ্পাপ আর সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ও আমাকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে বলছিল, কিন্তু আমি তা করার সাহস পাচ্ছিলাম না, কারণ বাইরে গেলে আমাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
কথাগুলো বলছিলেন তেহরানের মাহসা; যিনি একটি কুকুর পোষেন। পোষা প্রাণী জব্দ এবং তাদের মালিকদের গ্রেপ্তার করার জন্য শহরের নতুন আদেশের কথা উল্লেখ করে কথাগুলো বলেন তিনি।
ইরানের রাজধানী তেহরানে পুলিশ সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে পার্কে কুকুর নিয়ে হাঁটা যাবে না, এটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। জনসাধারণের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিধিনিষেধ প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
একই সঙ্গে বেশ কয়েক মাস বিতর্কের পর ইরানের পার্লামেন্ট শিগগিরই একটি বিল অনুমোদন করতে যাচ্ছে যার ফলে সারা দেশেই কুকুর, বিড়ালের মতো পোষা প্রাণী রাখা অপরাধ হয়ে যাবে।
প্রস্তাবিত আইনের বিধান অনুসারে, পোষা প্রাণীকে কেবলমাত্র তখনই বাড়িতে রাখা যাবে যদি এর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়।
এই আইন অনুসারে, বিড়াল, কচ্ছপ, খরগোশের মতো অনেক প্রাণীর আমদানি, বিক্রয়, পরিবহন ইত্যাদির জন্য ন্যূনতম ৪০০ মার্কিন ডলার জরিমানাও করা যেতে পারে।
এই বিলের বিরোধিতাকারী ইরানি ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডক্টর পায়াম মোহেবি এ বিষয়ে বলেন, এই বিল নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। সে সময় ইরানের সংসদ সদস্যদের একটি দল সব কুকুরকে ধরে নিয়ে চিড়িয়াখানায় দেওয়ার বা মরুভূমিতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেছিলেন।
ডক্টর মোহেবি আরও বলেন, তিনি দু’বার বিলটি সংশোধন করেছেন। এমনকি তিনি কুকুরের মালিকদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। তবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ইরানের গ্রামগুলোতে কুকুর পালন সবসময়ই খুবই সাধারণ একটি বিষয় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শহুরে জীবনধারাতেও সেটি খুবই পরিচিত দৃশ্য হয়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালে ইরান যখন প্রাণী কল্যাণ আইন প্রণয়ন করেছিল, তখন পশ্চিম এশিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশেই ওই ধরনের আইন হয়েছে। এর পরে সরকার পশু অধিকার প্রচারে দেশের প্রথম একটি সংস্থা তৈরি করতে সহায়তা করে। এমনকি দেশটির রাজপরিবারেও পোষা কুকুর ছিল।
১৯৭৯ সালে দেশটিতে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব দেশটিতে অনেক পরিবর্তন এনে দেয়।
ইসলামে পশুকে ‘অপবিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ইসলামী বিপ্লবের পর গঠিত নতুন সরকারের দৃষ্টিতে কুকুর ‘পাশ্চাত্যায়নের’ প্রতীক হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় সেখানকার কর্মকর্তারা এই প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টা শুরু করেন।
তেহরানের পশুচিকিৎসক আশকান শেমিরানি বলেন, কুকুর পোষা নিয়ে কথনও আলাদ করে কোনো নিয়ম ছিল না। তার মতে, কুকুর নিয়ে হাঁটলে বা গাড়িতে কুকুর রাখলে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। পুলিশ এটা করছে, কারণ পুলিশ মনে করে, এই কুকুর পোষার বিষয়টা পশ্চিমাকরণের লক্ষণ।
আশকান শেমিরানি বলেন, সরকার কুকুরের জন্য একটি কারাগারও তৈরি করেছে। আমরা সেই কারাগারের অনেক ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছি। সেখানে কুকুরগুলোকে অনেক দিন খোলা জায়গায় রাখা হয়েছিল পর্যাপ্ত খাবার বা পানি ছাড়াই। সেখানে কুকুরের মালিকরা সব রকমের আইনি ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
কয়েক বছর ধরে ইরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটও এই নতুন বিল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইরানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় পোষা প্রাণীর খাদ্য আমদানির ওপর তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিদেশি ব্র্যান্ডের আধিপত্যের এই বাজারে, সরকারের এই সিদ্ধান্তের অর্থ হলো- এর কালোবাজারির বাজার প্রস্তুত এবং এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুলও হয়ে উঠেছে।
ইরানের মাশহাদে একটি পশুচিকিৎসা ক্লিনিকের মালিক বলেন, আমরা এখন এমন লোকদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল যারা গোপনে এই ধরনের খাবার সরবরাহ করে। ফলে এসব খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি এসব খাবার মানসম্মত নয়। সস্তার মাংস বা মাছ দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও ব্যবহার করা হয়।
প্রস্তাবিত আইন শুধুমাত্র কুকুরকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে না, বিড়ালও এর অংশ। এই আইনে কুমিরের কথাও বলা হয়েছে। ইরান ‘পার্সিয়ান বিড়ালের’ জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত। এই বিড়াল বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিড়াল প্রজাতির একটি।
তেহরানের একজন পশুচিকিৎসক বলেন, আপনি কি বিশ্বাস করতে পারেন যে এমনকি পার্সিয়ান বিড়ালও তাদের নিজ দেশে আর নিরাপদ নয়? এই আইনের কোনো যুক্তি নেই। উগ্রবাদীরা শুধু মানুষকে তাদের ক্ষমতা দেখাতে চায়।
ইরানি ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডক্টর মোহেবি প্রস্তাবিত আইনকে লজ্জাজনক আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, যদি সংসদ এই বিলটি পাস করে, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের সেই মানুষ হিসাবে মনে রাখবে যারা কুকুর এবং বিড়ালকে নিষিদ্ধ করেছিল।
মাহসার মতো ইরানের অনেক পোষা প্রাণীর মালিক আসলে তাদের পোষা প্রাণীর ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তিত। তিনি বলেন, আমি আমার ‘ছেলের’ জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করার সাহস করতে পারব না। ওরা যদি আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে কী হবে? আমি ওকে রাস্তায় ফেলে যেতে পারব না।
এনএফ