হুইস্কিতে জাপানের বিশ্বজয়

একশ বছর আগে এক তরুণ জাহাজে চেপে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে। টাকা আয় করতে যাননি, সম্পদশালী হওয়ারও স্বপ্ন ছিল না তার। চেয়েছিলেন শুধু স্কচ হুইস্কি তৈরির কারিকুরি শিখতে। সেই তরুণের হাত ধরেই জাপান আজ বিশ্বজয়ী।
সম্প্রতি জাপানের তৈরি হুইস্কির ৭০টি বোতল বিক্রি হয়েছে অবিশ্বাস্য দামে। ৭০০ মিলিলিটারের (২৩.৬৭ আউন্স) প্রতিটি বোতল ক্রেতারা কিনেছেন ৪৬ লাখ ২০ হাজার ইয়েন বা ৩৪ হাজার ৮২০ ডলার (৩২ হাজার ৮০০ ইউরো) দিয়ে। ধনাঢ্য হুইস্কি রসিকেরা এই দামে ৭০ টি বোতল কিনে সাফ করে দিতে পুরো একদিনও সময় নেননি!
বিক্রির আগে বোতলগুলো অবশ্য ১৯ বছর ধরে পানরসিকদের জন্য ‘পাকানো' হয়েছে। হ্যাঁ, ফল যেমন পাকলে স্বাদে অতুলনীয়, হুইস্কিও তাই- যত পুরোনো হয় ততই নাকি পেকে পেকে স্বাদে অসাধারণ হয়।
তাকারা শুজো কোম্পানির শিরাকাওয়া ১৯৫৮ ব্র্যান্ডের হুইস্কিগুলো ফুকুশিমার প্রিফেকচারে তৈরির পর ২০০৩ সালে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়াজাকি প্রিফেকচারে। এত বছর সেখানে রেখে শুধু পানীয়টির স্বাদে ‘পূর্ণতা' দেয়া হয়েছে।
জাপানের আসাহি সংবাদপত্রকে তাই তাকারা শুজো কোম্পানির এক মুখপাত্র বলেন, শিরাকাওয়া ১৯৫৮-র ৭০টি বোতলের এমন দাম উঠেছে শুনে তিনি খুব বিস্মিত। তবে তিনি জানান, কোম্পানির অন্য সহকর্মীরা নাকি তাতে একটুও অবাক হননি, তারা মনে করেন, জাপানের খুব ভালো হুইস্কির এমন দাম খুবই স্বাভাবিক।
টোকিওভিত্তিক ডিলার হুইস্ক-ই লিমিটেড-এর প্রেসিডেন্ট কিমিতাকা তয়ামাও মনে করেন, জাপানের হুইস্কি গত কয়েক বছর ধরে প্রায় নিয়মিতই বিশ্বসেরার পুরস্কার জিতছে, তো বিশ্বসেরার দাম একটু বেশি হবে এতে বিস্ময়ের কী আছে!
স্কটল্যান্ডের হুইস্কি যেভাবে জাপানেরও হলো
আগামী বছর স্কটল্যান্ডের হুইস্কির জাপানে আসার একশ বছর পূর্ণ হবে। একশ বছর আগে কিয়োটোর অদূরে জাপানের প্রথম মল্ট হুইস্কি ডিস্টিলারির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ‘জাপানি হুইস্কির জনক' মাসাতাকা তাকেশুরু অবশ্য দেশে কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে হুইস্কি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
১৮৯৪ সালে তিনি ওসাকায় ব্রিউইং টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু হুইস্কি নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে মনে হলো এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হলে স্কটল্যান্ডে যেতে হবে।
১৯১৮ সালে হুইস্কি তৈরির ‘গোপন কৌশল' জানতে জাহাজে চড়ে স্কটল্যান্ডে চলে যান তাকেশুরু। সেখানে গিয়ে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু সনদ অর্জনের পড়া পড়েননি, পাশাপাশি স্পেসাইড, বাওনেস এবং ক্যাম্পবেলটাউনের তিনটি ডিস্টিলারি কোম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছেন। এভাবে হুইস্কি-বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার এক পর্যায়ে জেসি কাওয়ান, ওরফে রিটার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরে বিয়েও করেন তাকে।
১৯২০ সালে স্কটল্যান্ড থেকে জাপানে ফিরে আসেন তাকেশুরু। দেশে ফিরে প্রথমে কোতোবুকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শিনজিরো তোরির সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এই কোতোবুকিয়াই পরে পানীয়ের জগতের জায়ান্ট সুনতোরি হোল্ডিংস লিমিটেড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
সুনতোরি ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের বোতলজাত পানীয় বাজারে নিয়ে আসে ১৯২৯ সালে। ১১ বছর পর তাকেশুরু ঠিক করেন এবার নিজের উদ্যোগে আলাদাভাবে কিছু করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, হোক্কাইডোর উপকূলের কাছের ইয়োইচি শহরে প্রতিষ্ঠা করা হয় তার প্রথম ডিস্টিলারি।
সেখানে স্কটল্যান্ডের মতো একেবারে কয়লার আগুন ব্যবহার করেই হুইস্কি তৈরি শুরু হলো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর ফলে হুইস্কিতে যে মৃদু পোড়া পোড়া গন্ধটা আসে তাতে বেসরকারিভাবে জাপানের দ্বিতীয় পানীয় হয়ে ওঠা হুইস্কি আসলেই স্কচ হুইস্কির মতো লাগে।
তাকেশুরুর হুইস্কি প্রথম বাজারে আসে ১৯৪০ সালে। ৮০ বছর পর অবস্থাটা এমন যে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্কটল্যান্ডের হুইস্কি নিয়মিতই হারে জাপানের হুইস্কির কাছে। বিশ্বে এখন এমন কোনো বিখ্যাত বার নেই যেখানে জাপানের প্রদান ১১টি ডিস্টিলারির তৈরি হুইস্কি শোভা পায় না।
এসএস