হার না মানা বাংলাদেশের পঞ্চাশের গল্প
ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলোর একটি ছিল তৎকালীন বাংলার পূর্বাঞ্চল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পূর্ব-বাংলার এই দারিদ্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ সামলে উঠতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। একাত্তরের সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের হত্যা এবং দেশের অবকাঠামো একেবারে গুঁড়িয়ে দেয় পাক সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে খুব কম মানুষই আশাবাদী ছিলেন। শুক্রবার বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন চলছে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত দেশটির অর্থনীতি আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। করোনাভাইরাস মহামারির আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টানা চার বছর ৭ শতাংশের ওপরে ছিল; যা শুধুমাত্র পাকিস্তান এবং ভারতের চেয়ে বেশি নয় বরং প্রবৃদ্ধির এই হারে চীনকেও পেছনে ফেলেছে।
বাংলাদেশ শুধুমাত্র অর্থনীতিতেই সমৃদ্ধ নয়, বরং স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষায়ও ঈর্ষণীয় সাফল্য ধরে রেখেছে দেশটি। বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করছে; যা ১৯৮০ সালে ছিল বর্তমানের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। স্বাক্ষরতার হারও ঊর্ধ্বমুখী। শিশু মৃত্যুর হার নিম্নমুখী। উন্মুক্ত স্থানের পরিবর্তে এখন প্রত্যেকেই স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করছে। এমন সব ক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং ভারতের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এক অর্থে বাংলাদেশকে সফলতার মহাসড়কে তুলে দেয়। অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে নতুন দেশ পুনর্গঠনে ঝাপিয়ে পড়েন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্রিটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময়ে পড়াশোনা করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই সংস্থার মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের জন্য ওষুধ এবং গর্ভনিরোধক সামগ্রী বিতরণ করেন। ফজলে হাসান আবেদ লন্ডনে তার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে দাতব্য সংস্থা ব্র্যাকে অর্থায়ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ডায়রিয়া প্রাণঘাতী স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে হাজির হয়। ফজলে হাসান আবেদের এই সংস্থা কীভাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের পানিশূন্যতা রোধ করা যায় তা মায়েদের শিখিয়েছিল। বিপর্যস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার দাতব্য সংস্থাগুলোকে এ ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করার অনুমতি দিতে পেরে খুশি ছিল।
১৯৮০’র দশকে পোলিওর মতো রোগের বিরুদ্ধে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি দু’ভাগে বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে সরকার একাংশ এবং অন্য অংশের দায়িত্ব নেয় ব্র্যাক। ওই দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে শিশুদের পোলিও টিকাদানের হার ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়।
ব্র্যাকের মতো বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বিশেষভাবে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। কারণ তারা নারীদের নিয়ে কাজ করে। ১৯৯০’র দশকে বাংলাদেশে ৬৪ হাজার স্কুল পরিচালনা করে ব্র্যাক। তারা শুধুমাত্র মেয়েদের শিক্ষিত করেনি বরং এসব স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে। বর্তমানে বাংলাদেশে হাই স্কুলগামী মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় বেশি। এটিও ভারত, পাকিস্তানের তুলনায় আরেক অগ্রগতি বাংলাদেশের। ব্র্যাক এবং অন্যান্য সংস্থা বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণকে জনপ্রিয় করে তোলে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে তারা।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) রুবানা হকের মতে, বাংলাদেশের উদীয়মান পোশাক শিল্প নারীদের উন্নয়ন ও কল্যাণে সহায়তা করেছে। ৫০ বছর আগে এই খাতে বেতনভুক্ত নারীদের অংশীদারিত্ব মাত্র ৩ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা ৩৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের ৪০ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর প্রায় ৮০ শতাংশই এখন নারী। এই কাজ নারীদের ঘরে এবং বাইরে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মর্যাদা অর্জনে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান ১১ শতাংশ এবং রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। দেশের সরকার শ্রম আইন সহজ এবং আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এই শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফাহমিদা খাতুন দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, মুক্ত বাজারের এই পদ্ধতি গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা থাকলেও বাংলাদেশের উন্নয়ন বেশ আশাব্যাঞ্জক। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করার কিছুদিনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতায় আসার পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেন। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০১৫ সালে গ্রেফতার হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় সাত হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় বলে অভিযোগ করে বিএনপি। ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় পায়।
আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করে সমালোচক, সাংবাদিক এবং বিরোধীদের দমনে এটির ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আছে। দেশে বিভিন্ন সময় এই আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনও হয়েছে। এছাড়া সরকার দলীয় কিছু নেতাকর্মী ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ধরনের অনিয়ম দেশের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানেও বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটাতে শুরু করেছে বলে মনে করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক।
২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে ধনীদের আয় প্রায় এক চতুর্থাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে, দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ জন্য অভিজাত শ্রেণির সুবিধাবাদী আচরণকে দায়ী করেন। বিশ্বব্যাংকের ধারণা, শুধুমাত্র দুর্নীতির কারণে প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগও স্থবির।
করোনাভাইরাস মহামারি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ব্রাকের প্রধান আসিফ সালেহ বলেছেন, জাতীয় দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের হার প্রায় এক চতুর্থাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর কেউ কাজের জন্য বিদেশে যেতে পারেন না।
যা ভবিষ্যতের রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য অশনিসংকেত। গত বছর রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ছুঁয়েছিল। বিদেশে লকডাউনের কারণে পোশাক বিক্রি থমকে যাওয়ায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর কাজের অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
রুবানা হকের মতে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির গতি হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছর গড়ে প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে প্রত্যেক বছর এই হার মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
রুবানা হকের যুক্তি— আইনের শাসন অথবা রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ছাড়া নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা থামানো যাবে না।
ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলেও ৭৩ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন অথবা ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে তার উত্তরসূরী পাওয়া একটু কঠিনই হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশ সরকারের একজন উপদেষ্ঠা। কানাডায় বসবাসকারী তার বোন সায়মা ওয়াজেদ সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেছেন।
অন্যান্য প্রতিদ্বন্দীদের মধ্যে তাদের স্বজন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সরকারি নীতি নিয়ে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ শুরু করেছেন। এছাড়াও আছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাবা-মাকেও হত্যা করে ঘাতকরা।
এমন সব হিসেবে-নিকেশের বাইরে অনেকে বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদীদের উত্থানের আশঙ্কাও করছেন। ২০১৬ সালে চরমপন্থীরা ঢাকার একটি রেস্টুরেন্ট এবং বেকারিতে ২৪ জনকে হত্যা করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোসর হিসেবে এদেশে হত্যাযজ্ঞ চালানো জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিল এবং দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি আদালতে উঠেছে। তবে কট্টরপন্থী হেফাজত-ই-ইসলামির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত দিক থেকে আওয়ামী লীগের দূরত্ব থাকলেও সম্প্রতি তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। সাধারণ বাংলাদেশি; যাদের প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান— তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেশি ধর্মীয় অনুসারী হয়ে উঠেছেন। তবে খুব কম লোকই ধর্মীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে রয়েছে বলে মনে হয়।
প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ এতটাই পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে— সাধারণ বাংলাদেশীরা কী চায় তা বলা মুশকিল। বিগত ৫০ বছরে যত দ্রুত বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি মানুষের সে ধরনের উন্নতি হয় তাহলে তাদের বেশিরভাগই সন্তুষ্ট হতে পারেন। এই উন্নতির পেছনে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের অবদান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা ধন্যবাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন।
এসএস