দুই দিনে মণিপুরে ঢুকল মিয়ানমারের ৭ শতাধিক নাগরিক

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে মিয়ানমারের ৭ শতাধিক নাগরিক প্রবেশে করেছে। পরপর দুইদিনে এসব মানুষ মণিপুরে প্রবেশ করে এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব নাগরিকের কাছে বৈধ কোনও কাগজপত্র নেই।
ভারতের এই রাজ্যটি দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সহিংসতায় বিপর্যস্ত এবং সেখানেই একসঙ্গে মিয়ানমারের বিপুল সংখ্যক নাগরিক প্রবেশ করায় উঠেছে প্রশ্ন। মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২২ ও ২৩ জুলাই মাত্র দুই দিনে মিয়ানমারের কমপক্ষে ৭১৮ জন নাগরিক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে প্রবেশ করেছে। সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতেও বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে।
এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মাত্র দুই দিনে কিভাবে মিয়ানমারের অন্তত ৭১৮ জন নাগরিককে ‘যথাযথ ভ্রমণ নথিপত্র ছাড়াই’ ‘ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো’, সে বিষয়ে আসাম রাইফেলসের কাছে একটি বিশদ প্রতিবেদন চেয়েছে মণিপুর সরকার।
এনডিটিভি বলছে, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এই বিবৃতির তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এই বিবৃতিতে আসাম রাইফেলস-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, তাদের নজরদারি সত্ত্বেও দুই মাস ধরে জাতিগত সহিংসতার কারণে মণিপুরে বিরাজমান উত্তেজনার মধ্যে মাত্র দুই দিনে সাত শতাধিক বার্মিজ নাগরিক ভারতে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো।
এছাড়া মণিপুর রাজ্য সরকার নিজেই উদ্বিগ্ন যে, মিয়ানমারের এসব নাগরিক ভারতে পাড়ি জমানোর সময় তাদের সাথে অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনেছে কিনা তা জানার কোনও উপায় নেই। বিষয়টি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জানেন এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি পরিচয় প্রকাশ না করে এনডিটিভিকে একথা জানিয়েছেন।
মণিপুর স্বরাষ্ট্র বিভাগ সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৭১৮ জন শরণার্থী নতুন করে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং গত ২৩ জুলাই চান্দেল জেলা হয়ে মণিপুরে প্রবেশ করেছে বলে ২৮ সেক্টর আসাম রাইফেলসের সদর দপ্তর জানিয়েছে।
মণিপুরের মুখ্য সচিব ড. বিনীত জোশীর স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৈধ ভিসা বা ভ্রমণের নথিপত্র ছাড়াই মিয়ানমারের নাগরিকদের মণিপুরে প্রবেশে বাধা দিতে এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে সীমান্ত-রক্ষী বাহিনী আসাম রাইফেলসকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল মণিপুর সরকার।
রাজ্য সরকার বিবৃতিতে আরও বলেছে, ‘মণিপুর সরকার ৭১৮ শরণার্থীর নতুন করে অবৈধ প্রবেশকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখেছে। কারণ এই ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রভাব থাকতে পারে বিশেষ করে চলমান আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রভাব দেখা যেতে পারে।’
মণিপুর সরকার বলেছে, তারা ‘আসাম রাইফেলস কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে বিশদ প্রতিবেদন চেয়েছে যে, কেন এবং কীভাবে মিয়ানমারের এই ৭১৮ জন নাগরিককে যথাযথ ভ্রমণ নথি ছাড়াই ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো; এছাড়া সেই ৭১৮ জন বার্মিজ নাগরিককে চিহ্নিত করে অবিলম্বে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর কঠোর পরামর্শও’ দিয়েছে তারা।
এছাড়া চান্দেল জেলার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এবং মিয়ানমারের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক্স ও ছবি রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
উল্লেখ্য, প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে মণিপুর রাজ্যের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাঝে উত্তেজনা চলছে। গত মে মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় কুকি উপজাতিরা তফসিলি উপজাতির মর্যাদার দাবির প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ ঘিরে ওই দিন পার্বত্য এই রাজ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা ওই সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এতে কোটি টাকার সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এছাড়া রাজ্যের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কুকি গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে সেখানে দফায় দফায় আন্দোলনও হয়। মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মেইতেই সম্প্রদায়ের। তারপরও ওই রাজ্যের মোট ভূখণ্ডের মাত্র ১০ শতাংশের মালিকানা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে রয়েছে। ভারতের এই রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের বাইরে পাহাড়ী এলাকায় অন্য কারও জমি কেনার অনুমতি নেই।
সম্প্রতি ভারতের হাইকোর্ট মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিদের তালিকার অন্তর্ভূক্ত করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। হাইকোর্টের এই নির্দেশের পর নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর। মেইতেই সম্প্রদায়ের সদস্যরা তফসিলি উপজাতিদের তালিকায় ঠাঁই পেলে রাজ্যে জমি কেনার অনুমতি পাবেন।
এনডিটিভি বলছে, মণিপুর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে, তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে এখনও অনেক সময় লাগবে। গত ৩ মে থেকে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতায় দেড়শো জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও হাজার হাজার মানুষ।
এছাড়া দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট বিহীন অবস্থায় রয়েছে মণিপুর।
টিএম