যুদ্ধের হুঁশিয়ারির পর নাইজার ছাড়ছেন ইউরোপীয়রা

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার ছাড়তে শুরু করেছেন ফ্রান্স-সহ ইউরোপীয় দেশগুলোর শত শত নাগরিক। মূলত নাইজারের প্রতিবেশী দেশগুলো যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর ফ্রান্স তার দেশের নাগরিকসহ ইউরোপীয়দের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে।
এছাড়া ইতোমধ্যেই আড়াই শতাধিক ইউরোপীয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পৌঁছেছেন। বুধবার (২ আগস্ট) পৃথক দুই প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার নাইজার থেকে শত শত ফরাসি এবং ইউরোপীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে ফ্রান্স। নাইজারে ক্ষমতাচ্যুত সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর জন্য বাইরের কোনও হস্তক্ষেপকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে দেখা হবে বলে প্রতিবেশী মালি এবং বুরকিনা ফাসো ঘোষণা দেওয়ার পর তাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়।

এর আগে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুম এবং তার সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে নাইজারের সেনাবাহিনী। মোহাম্মদ বাজুম পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
অন্যদিকে বিবিসি জানিয়েছে, গত সপ্তাহের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ফ্রান্সবিরোধী মনোভাবের মধ্যে নাইজার থেকে তার নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে ফ্রান্স। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে নাগরিকদের সরিয়ে নিতে ফ্রান্স দেশটিতে তিনটি বিমান পাঠায় এবং এর মধ্যে একটি বিমানে করে ২৬২ জন ইউরোপীয় নাগরিক ইতোমধ্যেই প্যারিসে অবতরণ করেছেন।
সামরিক এই অভ্যুত্থানের জেরে নাইজারের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ফ্রান্সের দূতাবাসও আক্রমণের মুখে পড়েছে। দেশটিতে আগে থেকেই ফরাসি সেনা মোতায়েন রয়েছে এবং ফ্রান্স বলেছে, জঙ্গিদের মোকাবিলার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে সেখানে অবস্থানরত প্রায় ১ হাজার ফরাসি সৈন্যকে প্রত্যাবাসনের কোনো পরিকল্পনা নেই।

এছাড়া জার্মানি তার নাগরিকদের ফ্রান্সের প্রস্তাব গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে এবং নাগরিকদের সরিয়ে নিতে ইতালিও সেখানে ফ্লাইট পাঠিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর যে কোনও জোর প্রচেষ্টাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে দেখা হবে বলে বুরকিনা ফাসো এবং মালির জান্তারা হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
নাইজারের এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রও সাবেক ফরাসি উপনিবেশ এবং উভয় দেশই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের নিজস্ব সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর ফ্রান্স ছেড়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়া ক্ষমতাচ্যুত সরকারকে ফের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা নিয়ে তাদের যুদ্ধের হুঁশিয়ারিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, কারণ সেই ধরনের যেকোনও পরিস্থিতি জঙ্গি বিদ্রোহের সাথে লড়াইরত এই অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মূলত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ নাইজার আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে জিহাদি চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলে পরিচিত। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেরই সেখানে সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এছাড়া সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রবাহ রোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে নাইজার। সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের জন্য নাইজারে ইইউয়ের অল্প সংখ্যক সৈন্যও মোতায়েন রয়েছে।
আরও পড়ুন: সেনা অভ্যুত্থান: নাইজারে নিরাপত্তা ও বাজেট সহায়তা বন্ধ করল ইইউ
এর আগে নাইজারে সমস্ত উন্নয়ন সহায়তা এবং বাজেট সহায়তা স্থগিত করে ফ্রান্স। মূলত পশ্চিম ইউরোপের এই দেশটি ইতোপূর্বে মালি ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পরে ২০২১ সালে দেশটি তার আঞ্চলিক সামরিক সদর দপ্তর নাইজারে সরিয়ে নিয়েছিল।
বিবিসি বলছে, গত রোববার নাইজারের রাজধানী নিয়ামেতে ফরাসি দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। সেসময় দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভকারীরা ‘রাশিয়া দীর্ঘজীবী হোক’, ‘পুতিন দীর্ঘজীবী হোক’ এবং ‘ফ্রান্সের পতন হোক’ স্লোগান দেন। একপর্যায়ে তারা দূতাবাস কম্পাউন্ডের দেয়ালে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাইজারের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় সেনাবাহিনী। এর ফলে মানুষের পক্ষে তাদের নিজস্ব উপায়ে দেশটি ছেড়ে চলে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর তাই নাগরিকদের উদ্ধার করতে বিমান পাঠায় ফ্রান্স।
নাইজারে আনুমানিক ৬০০ ফরাসি নাগরিক এবং ১০০ জনেরও কম জার্মান নাগরিক রয়েছেন। বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, আফ্রিকার এই দেশটিতে মোট ৫০০ জনের মধ্যে প্রায় ৯০ জন ইতালীয় রয়েছেন রাজধানী নিয়ামেতে, যাদের অধিকাংশই সামরিক বাহিনীতে রয়েছেন।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের মতে, স্পেন ৭০ জনেরও বেশি স্প্যানিশ নাগরিককে আকাশপথে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য এখনই নাগরিকদের সরিয়ে আনার মতো কোনো পরিকল্পনা করছে না এবং নাইজারে তার নাগরিকদের বাড়ির ভেতরে থাকার জন্য অনুরোধ করেছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তারা আপাতত তার কর্মীদের সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে না।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রও তার নাগরিকদের এখনই সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে না। এছাড়া মার্কিন নাগরিক বা অবকাঠামোর ওপরও কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া মঙ্গলবার রাজধানী নিয়ামেতে পরিস্থিতি শান্ত ছিল বলেও জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, নাইজার বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশটি সরকারি উন্নয়ন সহায়তার অংশ হিসেবে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে পেয়ে থাকে। এছাড়া নাইজার হচ্ছে বিশ্বের সপ্তম-বৃহৎ ইউরেনিয়াম উৎপাদনশালী দেশ।
এমনকি ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার হচ্ছে নাইজার। পশ্চিমা দেশগুলো এই দেশটিকে পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ইসলামি বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।

পূর্বে বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতা বিরাজ করলেও, নাইজারকে সবচেয়ে স্থিতিশীল একটি দেশ হিসাবে দেখা হতো। নাইজারের বিদেশী মিত্ররা প্রেসিডেন্ট গার্ডের প্রধান জেনারেল আবদুরাহমানে তচিয়ানির নেতৃত্বাধীন নতুন সামরিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে। গত শুক্রবার তাকে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা হয়।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশ এখনও মোহাম্মদ বাজুমকেই বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
টিএম