কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু, পেছনে র্যাগিং?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’কে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে নামকরা ওই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। গত বুধবার মাঝরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেইন হোস্টেল’-এর তিনতলা থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় মাত্র তিন দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর।
তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার খুনের মামলা রুজু করে পুলিশ। ছাত্রটির আত্মীয়রা অভিযোগ করেছেন, তাকে হোস্টেলে র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল। এ ঘটনায় পুলিশ শুক্রবার রাতে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এছাড়া সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া ছাত্রটির মৃত্যুর প্রতিবাদে ক্লাস বয়কট করছেন শিক্ষকরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র নেতা-নেত্রীরা বলছেন, হোস্টেলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে অভিযোগ আনেন না ভয়ে, তাই তারাও জানতে পারেন না যে হোস্টেলগুলোতে ঠিক কীভাবে র্যাগিং চলছে।
ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং নিয়ে কড়া আইন আছে। র্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ছাত্র বা ছাত্রীকে বহিষ্কার তো করা হয়ই, অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাতে তিনি ভর্তি না হতে পারেন, সেই শাস্তিরও বিধান রয়েছে।
কীভাবে মৃত্যু প্রথম বর্ষের ছাত্রটির?
নদীয়া জেলার বগুলার বাসিন্দা স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাত্রই গত রোববার তারা তাদের ছেলেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে রেখে এসেছিলেন। ছাত্রটি দ্বাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি টানের কারণে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পড়তে ভর্তি হয়েছিল সে।
ওই ছাত্রের মামা অরূপ কুণ্ডু সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘প্রথম তিনদিন সে ক্লাসও করেছিল, কিন্তু বুধবার রাতে সে বাড়িতে ফোন করে জানায় তার খুব ভয় করছে, বাবা-মা এসে যেন দ্রুত তাকে নিয়ে যান।’
তিনি জানান, ‘তার মাকে সে ফোনেই জানিয়েছিল যে অনেক কিছু বলার আছে তার। ওর বাবা-মা বলেছিল একটা রাত কোনওমতে কাটিয়ে দিতে, পরের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালেই তাকে নিয়ে আসবেন। এরপর আর চেষ্টা করেও ওর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারিনি। রাতে হোস্টেলেরই এক সিনিয়র স্বপ্নদীপের বাড়িতে ফোন করে জানান, সে তিনতলা থেকে পড়ে গেছে।’
হোস্টেলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে বৃহস্পতিবার ভোরে তার মৃত্যু হয়।
স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডু পুলিশকে জানিয়েছেন, হোস্টেলের কিছু ছাত্রই তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী। পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, তারা হোস্টেলের আবাসিক ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং শুক্রবার রাতে একজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওই হোস্টেলেই মারাত্মক র্যাগিংয়ের অভিযোগ
স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর মৃত্যুর পরে অর্পণ মাঝি বলে প্রথম বর্ষেরই এক ছাত্র সামাজিক মাধ্যমে একটা মারাত্মক অভিযোগ পোস্ট করেন। স্বপ্নদীপের সঙ্গে একই হোস্টেলে থাকতে শুরু করেছিলেন অর্পণ মাঝি, যদিও দুজনের বিষয় ছিল আলাদা।

ভূবিজ্ঞান বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া অর্পণ মাঝি লিখেছেন, ‘আমার পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবার এবং আমি আসানসোলে বড় হয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভর্তির সময় হোস্টেল অ্যাপ্লাই করেছিলাম। জীবনে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার পর দুই তিন রাত হোস্টেল আমার কাছে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। আমি এখন অনেক কষ্ট করেই, ধার নিয়ে হলেও মেস খুঁজছি।’
তিনি লিখেছেন, ‘সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন আছে, কিন্তু যাদবপুর মেইন হোস্টেলের কিছু দাদা’ও যে এই একই কাজ করবে তা আমার কল্পনার অতীত। মাথায় একটি স্পেসিফিক ছাঁটের চুল কাটতে বলা, সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকতেই হবে, সিনিয়রদের ক্রমাগত ফাইফরমাশ খাটা, সারারাত জাগিয়ে রেখে ইন্ট্রো নেওয়া (শুনতে পারছি যে এখনও আসল ইন্ট্রো নেওয়াই হয়নি)। এগুলো ওই তিন রাত আমার সাথে চলছে এবং আমি ভীত।’
এরপরে একে একে আরও কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক ছাত্র-ছাত্রী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও ছাত্রী আবাসগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে কি ধরনের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চলে, তার বর্ণনা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করতে থাকেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী-আবাসেও ঠিক কীভাবে র্যাগিং করা হয়, সেই বর্ণনাও কয়েক জন সাবেক ছাত্রী শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। ছাত্রীদের লেখা ওই সব বর্ণনায় যা উঠে এসেছে, তা যৌন হেনস্থার শামিল বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও হোস্টেলে কি ধরনের র্যাগিংয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা কি কিছুই জানতেন না কেউ?
এক অধ্যাপক বলছেন, ‘আমরা টের পেতাম যে, হোস্টেলগুলোতে র্যাগিং হচ্ছে, কিন্তু তা যে এতটা ভয়াবহ, সেটা আন্দাজ করা যায়নি। আসলে হোস্টেলে যারা থাকে, তারা তো কলকাতার বাইরে থেকে মফস্বল শহর বা গ্রামাঞ্চল থেকে আসে, আর তাদের এমন ভাবে ভয় দেখানো হয় যে বাইরে কিছু জানাতে তারা সাহস করতে পারে না।’
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা বৃহস্পতিবার দল বেঁধে হোস্টেলে গিয়েছিলেন প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মনে সাহস যোগাতে। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে আর বহিরাগত বা সাবেক ছাত্রদের হোস্টেলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। বিবিসি বাংলা
টিএম