করোনায় বিশ্ব মঞ্চে বাঁক বদলের চার ঘটনা 

Saifuzzaman Sumon

২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৩ পিএম


করোনায় বিশ্ব মঞ্চে বাঁক বদলের চার ঘটনা 

২০২০ সালটি অন্যান্য বছরের মতো নয়। এ বছর বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ৮ কোটির বেশি মানুষকে সংক্রমিত ও ৮০ শতাংশ মানুষের চাকরিতে প্রভাব ফেলেছে। কোটি কোটি মানুষকে লকডাউনে যেতে বাধ্য করেছে।

মহামারি ছাড়া কীভাবে এই বছরটি আলাদা হয়ে উঠতে পারে সেটিও কল্পনা করা যেতে পারে। প্রিয়জনদের সঙ্গে আগে কি অতিরিক্ত সময় কাটানো হতো? জন্মদিন, বিবাহ অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য মাইলফলক কি কখনও মিস করেছি? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি। 

যদিও এই সঙ্কট আমাদের সবার ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করেছে, তারপরও বিশ্বজুড়ে সংবাদের জন্ম দিয়েছে; যা কোটি কোটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। করোনা মহামারির কারণে বদলে যাওয়া বিশ্বের চার মহাদেশের চারটি রাজনৈতিক সঙ্কট তুলে ধরা হল– 

১. মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন খুবই ভিন্ন ধাঁচের, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ ও অঞ্চলের নজরে থাকে এই নির্বাচন। সভা-সমাবেশ, জমজমাট প্রচারণায় ব্যস্ত থাকে মার্কিন নির্বাচনী ময়দান। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি চিরাচরিত মার্কিন নির্বাচনী প্রথাকে থমকে যেতে বাধ্য করেছে। হঠাৎ হানা দেয়া করোনায় এবার নির্বাচনী সভা-সমাবেশ স্থগিত করা হয়। ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়নপত্র নেয়ার দিনে জো বাইডেন হাজির হয়েছিলেন প্রায় জনশূন্য এক কক্ষে। সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে।

হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাটকীয়ভাবে হাসপাতালে উড়ে যান। এরমাঝেই গত ৩ নভেম্বর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের নীতিই তার পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ। 

এমোরি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালাম আব্রামোয়িৎজ বলেন, ‌‌‘এটা স্পষ্ট যে, মহামারির প্রভাব ট্রাম্পকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট মহামারি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’ এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরার মতো জনস্বাস্থ্য বিধিগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে জনগণকে নিরুৎসাহিত করেছেন ট্রাম্প। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে অনেক ভোটার ট্রাম্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় জো বাইডেনের জয়ে ভারসাম্য এসেছে। 

মার্কিন এই অধ্যাপক বলেন, ‘মানুষ এই সঙ্কটেও কাকতালীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনে সমাবেশও করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি গুরুত্ব দিয়ে এবং কার্যকরভাবে এই মহামারি মোকাবিলা করতেন, আমার মনে হয়— তিনি খুব সহজেই নির্বাচনে জয়ী হতেন।

মহামারির কারণে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে; যা সাধারণত আগামী প্রেসিডেন্টকেও বিপদে ফেলবে। ১৯৮৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করে আসা ইতিহাসবিদ অ্যালাম লিচম্যান গত আগস্টে জো বাইডেন নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ অন্তত ১৩টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে মার্কিন নির্বাচনী ফলের ব্যাপারে কয়েক দশক ধরে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন তিনি।  

আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, ‘মহামারি মোকাবিলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা তার পরাজয় ডেকে এনেছে। করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে রীতিমতো মশকরা করছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যে কারণে মহামারি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নীতির বিপরীতে মূল্য গুণতে হয়েছে নির্বাচনে হেরে।’

dhakapostএছাড়া করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় ডেমোক্র্যাট শিবির বেশিরভাগ নির্বাচনী প্রচারণা অনলাইনে সেরেছে। যা বাইডেনের প্রচারণায় সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে নির্বাচনী সমাবেশ করেছিলেন। 

দুই. হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন

২০১৯ সালে বিশ্বে হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের টানা আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রে টানা বিক্ষোভ-প্রতিবাদের বিভিন্ন সময়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়েন গণতন্ত্রপন্থীরা। পুলিশ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস এবং গোলাবর্ষণ করে। বেইজিং এই বিক্ষোভের নিন্দা জানালেও হংকংয়ের বাসিন্দাদের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা তৈরি হয়।

এমনকি গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীরা ভূমিধস জয় লাভ করেন। 

কিন্তু চলতি বছরের বেশিরভাগ সময় হংকং প্রায় শান্ত ছিল এবং আন্দোলন থমকে যায়। গণতন্ত্রপন্থী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই পদত্যাগ এবং ভূখণ্ড ছেড়ে পালিয়েও যান।

হংকংয়ে করোনাভাইরাস প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় গত জানুয়ারিতে। যে কারণে বছরের শুরুতে বিক্ষোভ কিছুটা ঢিলে হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেছেন সেখানকার শিক্ষার্থী-মানবাধিকার কর্মী জোয়ে সিউ। তিনি বলেন, ‘হংকংয়ের বাসিন্দারা ভাইরাসের ভয়াবহতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। কারণ আমাদের ২০০৩ সালের সার্স প্রাদুর্ভাবের অভিজ্ঞতা ছিল।’

করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনে হংকং। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে মহামারিতে মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে পারেনি। এই মহামারির সবচেয়ে বড় প্রভাব গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভের ওপর পড়ে।

নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ভিক্টোরিয়া হুই বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ সবসময়ই সরবকারবিরোধী বিক্ষোভ থামাতে চেয়েছে এবং জনস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে সেটি করতে সক্ষমও হয়েছে।’ সামাজিক দূরত্ব বিধি নিশ্চিতে গণতন্ত্রপন্থী বেশ কয়েকজন কর্মীকে জরিমানা এবং বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয় এই ভূখণ্ডে।

dhakapost
 তবে অনেকেই আইন-শৃঙ্খলবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে পারলেও করোনা মহামারির কারণে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া হুই বলেন, বর্তমানে জনসমাগম নিষিদ্ধ রয়েছে। গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলনে অংশ নেবেন; এমন মনে হলেই পুলিশ যে কাউকে ধরে জরিমানা করছে। এই জরিমানার পরিমাণ কমপক্ষে ২৬০ মার্কিন ডলার।

বিজ্ঞানের ভিত্তিতে করোনাভাইরাস স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করা হয়েছে; যা সংক্রমণ রোধ করার জন্য জরুরি।

হংকংয়ের সরকার

এসবের পাশাপাশি হংকংয়ে বড় ধরনের দুটি ঘটনা ঘটেছে। নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি এবং সংসদ নির্বাচন বাতিল। হংকং কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপের কারণে গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন সীমিত হয়ে পড়ে। গত নভেম্বরে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী সাংসদদের সবাই গণপদত্যাগ করেন। এর ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হংকংয়ের পার্লামেন্ট বিরোধীশূন্য হয়ে পড়ে। 
   
তিন. ইথিওপিয়া টাইগ্রে সংকট

২০২০ সালের আগে অনেকেই আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের দেশ ইথিওপিয়ার টাইগ্রের নাম হয়তো কখনই শুনেননি। গত নভেম্বরে ইথিওপিয়ার সরকার এবং টাইগ্রের আঞ্চলিক দল টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের  (টিপিএলএফ) সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়। এতে শত শত মানুষের প্রাণহানি এবং ৪০ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিবেশি সুদানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই সংঘাত সমগ্র টাইগ্রে অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
  
টাইগ্রের আঞ্চলিক সংঘাতের নেপথ্যে ছিল করোনাভাইরাস মহামারির অজুহাত দেখিয়ে দেশটির সরকারের জাতীয় নির্বাচন বাতিল ঘোষণা। 

এই যুদ্ধের প্রধান ও মৌলিক কারণ ছিল নির্বাচন বাতিল ঘোষণা।

স্থানীয় গণমাধ্যম আদ্দিস স্ট্যান্ডার্ডের প্রধান সম্পাদক সেতালে লেমা

নতুন প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইথিওপিয়ায় গণতান্ত্রিক সংস্কার আনার অঙ্গীকার করেন। কয়েক দশকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো গত আগস্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নির্ধারিত ছিল। সেতালে লেমা বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে প্রত্যেকেই বেশ উত্তেজিত ছিলেন।

তিনি বলেন, এই নির্বাচন ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে তুমুল রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল। যদিও অনেকেই নির্বাচন পরবর্তী সম্ভাব্য সহিংসতার ব্যাপারে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তারপরও জনগণের প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন হলে উত্তেজনা প্রশমিত হবে।

গত মার্চে দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারি প্রথমবারের মতো হানা দেয়। সেই সময় দেশটির নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বাতিলের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তা মেনে নেয়। 

দেশটির সরকারের মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল। নির্বাচন বাতিলের কারণে আফ্রিকার এই দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেয়। 

সেদালে বলেন, নির্বাচনের বাতিলের পর কি ঘটতে যাচ্ছে সেব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধীদের সঙ্গে কোনও ধরনের বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। দেশটির আইন পরিষদের একাংশ সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্ত দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে ভোটাভুটিতে অনুমোদনও পায়। 

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক কমফোর্ট এরো বলেন, আগে থেকে জ্বলন্ত এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত এবং করোনাভাইরাস মহামারি নতুন করে জ্বালানির জোগান দেয়। 

dhakapostতিনি বলেন, ‘ইথিওপিয়া ইতোমধ্যে আঞ্চলিক সহিংসতার হুমকি এবং সরকারের সঙ্গে আঞ্চলিক উত্তেজনা নিয়ে ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। নির্বাচন বাতিলকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের প্রতিদ্বন্দীদের সঙ্গে আলোচনা না করার এবং এককভাবে কাজ করার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখেন বিরোধীরা।’

ফেডারেল সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর টাইগ্রে অঞ্চলে নির্বাচন সম্পন্ন করে আবি আহমেদের দীর্ঘদিনের বিরোধী টিপিএলএফ। কেন্দ্রীয় সরকারকে উপেক্ষা করে টিপিএলএফ; যদিও দেশটির সরকার টাইগ্রের এই রাজনৈতিক দলের জয়ের স্বীকৃতি দেয়নি। 

ইথিওপিয়ার সৈন্যরা নভেম্বরের শেষের দিকে টাইগ্রের রাজধানী দখলে নিয়ে বিজয় ঘোষণা করেন। কিন্তু তারপর ওই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে এখনও লড়াই অব্যাহত আছে। ওই অঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এই সংঘাতের ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘ।

এই সংঘাত অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক। এর ফল খুবই দুঃখজনক। জনমতের ভিত্তিতে আমরা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছি।  

আদ্দিস স্ট্যার্ন্ডার্ডে প্রধান সম্পাদক সেদালে

চার. ইসরায়েলের রাজনৈতিক সংকট

গত এপ্রিলের দিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলতে শুরু করেন যে, করোনাভাইরাস মহামারি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবনকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। 

এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতায় রয়েছে ইসরায়েল। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মোট তিনবার দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনও রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গন্তেজের সঙ্গে ঐক্যের সরকার গঠন করে পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।  

এমনকি নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে সর্বশেষ গত মার্চের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থনে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকা গন্তেজকে প্রথমবারের মতো সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজের নিয়মিত নিবন্ধ লেখক আনশেল ফিফার বলেন, তারপরও বিরোধীরা সরকার গঠন করতে সমস্যার মুখোমুখি হয়। কারণ তারা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী থেকে বামপন্থী কমিউনিস্টদের সমন্বয়ে বৃহৎ জোট গঠন করেছিল। কিন্তু এর মাঝেই করোনাভাইরাস মহামারি হানা দেয়। সেসময় নেতানিয়াহু তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। 

তিনি বলেন, দেশে জরুরি অবস্থা চলছে বলে অনেকেই ধারণা করছিলেন। করোনাভাইরাস নীতিমালা গ্রহণ করে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশকে একমাত্র তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবনের চরম সংকটের সময় সর্বোত্তম সুযোগ তৈরি করে দেয় করোনা মহামারি। এর ফলে নেতানিয়াহুর সঙ্গে সরকার গঠনে গন্তেজের ওপর চাপ তৈরি হয়।

dhakapostযদিও গন্তেজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুকে কখনই মেনে নেবেন না এবং তার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না বলে জানিয়ে দেন। অস্থিতিশীল এই সময়ে নেতানিয়াহুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে গন্তেজ বলেন, এটা স্বাভাবিক সময় নয়। যদিও নিজের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেননি গন্তেজ; নেতানিয়াহুর সঙ্গে ঐক্যের সরকার গঠন করেন তিনি।

ঐক্যের সরকার গঠনের শর্তে প্রথমে নেতানিয়াহু এবং পরে গন্তেজের পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার কথা বলা হয়। এই সমঝোতাকে ইসরায়েলের ধুঁকতে থাকা রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত নেতানিয়াহুকে বিরোধীরা পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে এলেও তাতে কর্ণপাত না করে বরং নতুন করে ঐক্যের সরকার গঠনের পথে এগিয়ে যান তিনি। ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা এবং বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে মামলা দায়ের হলেও নেতানিয়াহু তা দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করে আসছেন। 

করোনাভাইরাস মহামারি নেতানিয়াহুকে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা তৈরি করে দেয়। এই সঙ্কটের পেছনে পুরো সমস্যাটি ছিল ফৌজদারি মামলার বিচার; যেখানে তিনি সময়ক্ষেপণ চান।  

গ্লোবসের কূটনৈতিক প্রতিবেদক ট্যাল স্নাইডার

অন্যদিকে, নেতানিয়াহুর জন্য কোনও ধরনের রাজনৈতিক হুমকি তৈরি করতে পারেননি গন্তেজ। নেতানিয়াহুর সঙ্গে সরকার গঠনের মাধ্যমে তিনি ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলে মনে করেন অনেকে।

কিন্তু ঐক্যের এই সরকার বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। সরকারি বাজেট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মাত্র ৮ মাস পর ইসরায়েলের সরকার ভেঙে পড়ে। দুই বছরের মধ্যে চতুর্থবারের মতো আগামী মার্চে ইসরায়েলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন নেতানিয়াহু।

সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা। 

এসএস

Link copied