ভারতে যেসব কারণে ধ্বংসাত্মক করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রবার্টগঞ্জ জেলার অধিবাসী ৫৮ বছর বয়সী রাজেশ্বরী দেবী তীব্র শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু করোনা সনদ না থাকায় সেখানে হাসপাতালের জরুরি সেবাদান কক্ষে রাখা হয় তাকে।
সিটি স্ক্যানে জানা যায়, তিনি দীর্ঘস্থায়ী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা অক্সিজেন দেওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন রাজেশ্বরী দেবীর আত্মীয়দের জানায়, যে তাদের অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে এবং অবিলম্বে রাজেশ্বরী দেবীকে কোনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা প্রয়োজন, তখন এলাকার এক রাজনৈতিক নেতার সহযোগীতায় অনেক কষ্টে অপেক্ষাকৃত বড় একটি হাসপাতাল রাজেশ্বরী দেবীর জন্য একটি শয্যার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন তার পরিবারের সদস্যরা।
কিন্তু শয্যার ব্যবস্থা করা গেলেও জোগাড় করা যায়নি অ্যাম্বুলেন্স। শেষে নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতেই তাকে সেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার সময় তাকে অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হয়নি এবং সেখানে পৌঁছে নির্ধারিত শয্যায় শোয়ানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু হয় রাজেশ্বরী দেবীর।
রাজেশ্বরী দেবীর ছেলে আশীষ অগ্রহরি বিবিসিকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘মা যদি ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেতেন, তাহলে এ যাত্রা তাকে বাঁচানো যেতো।
ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন দেশজুড়ে যে হাজার হাজার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে, রাজেশ্বরী দেবীর ঘটনা তার একটি মাত্র। ভারতের চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হাসপাতল কর্তৃপক্ষরা বলছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর জনজীবনে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা কয়েকগুণ হয়ে ফিরে এসেছে। যে সংকটগুলো এখন সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে, সেগুলো হলো—
লাগামহীনভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি

ভারতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল কেরালায়, ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি। ছয় মাস পর, জুনের ১৮ তারিখ ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার।
এরপর থেকেই উর্ধ্বমূখী হতে শুরু করে সংক্রমণের রেখচিত্র। আগস্ট নাগাদ ভারতে দৈনিক সংক্রমণ পৌঁছায় ৩৫ হাজারের কোটায়। সেপ্টেম্বরে ভারতে দৈনিক সংক্রমণ উন্নীত হয় ৯০ হাজারে।
অক্টোবর-নভেম্বর থেকে কমতে শুরু করেছিল দৈনিক সংক্রমণ ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি ভারতে দৈনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ হাজার।
কিন্তু মার্চ থেকে ফের বাড়তে শুরু করে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। গত বছরের রেকর্ড ভেঙেচুরে যায় মার্চের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসেই; তখন ভারতে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিলেন লক্ষাধিক মানুষ।
সম্প্রতি এই সংখ্যা বেড়েছে আরো প্রায় তিনগুণ। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার ভারতে করোনায় নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় তিন লাখে, এবং এই দিন এ রোগে মারা গেছেন ২ হাজার ২৩ জন।
ভারতের কেরালা রাজ্যের করোনা টাস্কফোর্সের সদস্য ডা. ফাতাহ উদ্দিন বিবিসিকে বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে আমি বলেছিলাম—করোনা এখনো বিদায় নেয়নি এবং আমরা যদি সতর্ক না হই সেক্ষেত্রে করোনা সুনামি দেখা দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত আমার আশঙ্কা সত্য হয়ে গেল।’
তিনি জানান, ধর্মীয় উপলক্ষ্যে জনসমাগম, অফিস-আদালতসহ জনসমাগমপূর্ণ স্থানগুলো খুলে দেওয়া এবং নির্বাচনী প্রাচার-প্রচারণার ফলে সংক্রমণের সাম্প্রতিক উল্লফন ঘটেছে বলে মনে করছেন তারা।
হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট
এদিকে সংক্রমণের এমন লাগামছাড়া পরিস্থিতিকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে হাসপাতালগুলোর শয্যা সংকট। ভারতের অনেক শহরে শয্যা সংকটের কারনে বিপাকে পড়েছেন করোনা গুরুতর অসুস্থ রোগীরা। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় সেখানে প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।

সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে দিল্লি, মুম্বাই ও আহমেদাবাদ। এই তিন শহরের হাসপাতালগুলোতে কোনো খালি শয্যা নেই। এছাড়া লখনৌ, ভোপাল, কলকাতা, প্রয়াগরাজ ও সুরাটের হাসপাতালগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। দৈনিক সংক্রমণে হ্রাস টানা না গেলে খুব দ্রুত এই শহরগুলোর হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা দেখা যাবে।
ভারতের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনন্ত ভান অবশ্য এ জন্য নিজেদেরকেই দায়ী করেছেন। বিবিসিকে অনন্ত বলেন,‘আমরা করোনার প্রথম ঢেউ থেকে কোনো শিক্ষা নেইনি। প্রথম ঢেউ যখন চলছিল, তখনই কয়েকটি শহরের হাসপাতালগুলোতে এই সংকট দেখা দিয়েছিল। আমরা যদি সেখান থেকে শিক্ষা নিতাম, সেক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি আমাদের থাকত।
গোপন করা হচ্ছে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা
ভারতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৭০ জন, এর মধ্যে মঙ্গলবার দেশটিতে মারা গেছেন ২০২৩ জন। তবে সাংবাদিকরা বলছেন, সরকার দৈনিক মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা গোপন করছে।
লখনৌয়ের একজন ফটোসাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, ‘গত ১৪ এপ্রিল ছবি তোলার কাজে আমি একটি শ্মশানে গিয়েছিলাম। ওইদিন সেই শ্মশানে ১০০ টি মরদেহ সৎকার হয়েছে, আমি নিজে গুনে দেখেছি। অথচ উত্তর প্রদেশ সরকার জানিয়েছে, রাজ্যে সেদিন করোনায় মোট মারা গেছেন ৮৫ জন।’

উত্তর প্রদেশের বারানসী শহরের এক ফটো সাংবাদিক একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন উল্লেখ করে বিবিসিকে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, সরকার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা লুকাচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনন্ত ভান এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেন, ‘প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের সামনে আসছে না— এটি সত্য, কারণ হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অনেক রোগী বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। বাড়িতে যেসব মারা যাচ্ছেন, তাদের হিসেবটা অনেক সময় আমাদের সামনে আসছে না।’
‘তাছাড়া অনেকে করোনা আক্রান্ত হলেও হাসপাতলগুলোতে চাপের কারণে টেস্ট করাতে পারছেন না এবং এক পর্যায়ে মারা যাচ্ছেন। তাদের হিসেবও আমরা পাচ্ছি না।’
সূত্র: বিবিসি
এসএমডব্লিউ