বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ত্রিপুরার বাসিন্দারা কেন আতঙ্কিত?
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে চাপা উত্তেজনা চলছে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার এ রকমই একটি গ্রাম কালীপুর। মাত্র ৪০টি পরিবারের বসবাস রয়েছে এই গ্রামে। কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে সেখানকার মানুষ তাদের রোজকার পরনের জামাকাপড় শুকাতে দেন।
তবে সেখানকার নিত্যদিনের দৃশ্য ৫ আগস্টের পর কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন বিএসএফ ওই গ্রামে কড়া নজরদারি চালাচ্ছে। এর ফলে গ্রামের মানুষের মনে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ত্রিপুরা রাজ্য ঘুরে সরেজমিন প্রতিবেদন করেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির হিন্দি বিভাগের প্রতিনিধি দিলীপ কুমার শর্মা। তিনি বলেন, বিকেল পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। কালীপুর গ্রামের বাসিন্দা পুতুল মালাকার সব কাজকর্ম সেরে ঘরে ঢুকে পড়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। ৫ আগস্টের আগে মালাকারকে ঘরে ফেরার জন্য এরকম তাড়াহুড়ো করতে হতো না।
তিনি বলেন, ‘‘সীমান্ত এলাকায় আমাদের এমনিতেই নানা সমস্যার মধ্যে বসবাস করতে হয়। আর এখন তো সেটা আরও বেড়েছে। পুরো রাত আমাদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কে জানে কখন কোথায় গণ্ডগোল হয় বা সীমান্তের অন্য দিক থেকে এসে আমাদের ওপরে হামলা না করে দেয় কেউ! এভাবেই আতঙ্কের মধ্য দিয়ে আমাদের দিন কাটছে।’’
• বিএসএফকে না জানিয়ে ঢুকতে পারে না কেউ
ভারতের সীমানায় থাকা কাঁটাতারের বেড়া এই গ্রামের মানুষদের জন্য এখন যেন আরও বড় রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালীপুর গ্রামে ঢুকতে এখন যে কাউকে বিএসএফের অনুমতি নিতে হচ্ছে। তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ কোনোভাবেই গ্রামে ঢুকতে পারছেন না।
গ্রামের প্রবেশের মুখেই বিএসএফের চৌকি আছে। সেখানে প্রহরারত বিএসএফ সদস্য সবার আসা-যাওয়ার ওপর কড়া নজর রাখেন। সীমান্তরক্ষীদের কড়াকড়ি নিয়ে মালাকার বলেন, বাংলাদেশে যখন থেকে অশান্তি শুরু হয়েছে, তারপরই বিএসএফ এখানে আরও কড়াকড়ি করছে। মাস পাঁচেক আগে পরিস্থিতি এরকম ছিল না।
‘‘বিএসএফ বলে দিয়েছে যে বেশি রাত পর্যন্ত যেন আমরা বাইরে না থাকি। আমি তো সন্ধ্যা হতেই ঘরে ঢুকে যাই। বাইরে থেকে কোনো আত্মীয়স্বজন এলেও তার পরিচয়পত্র বিএসএফের চৌকিতে দেখাতে হয়।’’
আগে আত্মীয়স্বজনদের জন্য এতটা বিধি-নিষেধ ছিল না বলেও তিনি জানান। পুতুল মালাকার এখন নিজের চাষের ক্ষেতেও যেতে পারছেন না। গ্রামের অর্ধেক মানুষেরই চাষের জমি কাঁটাতারের বেড়ার ওদিকে। কিন্তু কেউই সেদিকে যেতে পারেন না এখন, বলেন তিনি।
• নতুন বিভেদ
বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের চার রাজ্য—আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম আর ত্রিপুরার মোট এক হাজার ৮৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত আছে। এর মধ্যে ত্রিপুরার ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্তই দীর্ঘতম।
ত্রিপুরার উনকোটি জেলাতেই ৭৩ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত আছে, যেখানে একেবারে সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের সংখ্যা ১৫টিরও বেশি। কালীপুরও সেরকমই একটি গ্রাম। উনকোটি জেলারই আরেকটি ছোট গ্রাম সামরুরপাড়। সেখানকার বাসিন্দা দিলীপ দাসও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই বিরক্ত।
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন দাস। তার মনে হয়, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যেন বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের একটা নতুন বিভেদ তৈরি করে দিয়েছে।
তার কথায়, ‘‘দুই দেশের মধ্যে যেন একটা নতুন বিভেদ তৈরি হয়েছে। আমাদের হয়েছে সমস্যা। কারণ আমাদের বহু আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশে থাকেন।’’
‘‘পাঁচ মাস আগেও আমাদের মধ্যে যাওয়া-আসা লেগে থাকত। কিন্তু এখন শুধুই হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে খবরাখবর নিতে পারি। সামাজিক মাধ্যমে যা খবর পাই তাতে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে নাকি খুব অত্যাচার হচ্ছে। এর জন্য সবসময়েই আমাদের খুবই চিন্তা হয়।’’
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত দেখে তার এখন মনে হয় যেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি চলছে। তিনি বলেন, যদি ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে, তাহলে ওখানে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপরে যদি অত্যাচার করা হয়, তাহলে সেটা নিয়ে এদিকেও হাঙ্গামা হবে। আমরা পড়ব মুশকিলে।
তার কথায়, ‘‘আমরা থাকি একেবারে সীমান্তে। তাই এ ধরনের বেশকিছু কথাবার্তা ছড়িয়েছে গ্রামের মানুষের মধ্যে। সেজন্যই সবসময় আতঙ্কে থাকি।’’
• আওয়ামী লীগ সদস্য আত্মীয়রা পালিয়েছেন
আরেকটি গ্রাম কালারকান্দির বাসিন্দা নাজমুল হুসেইনও উদ্বেগে রয়েছেন। তার বেশ কয়েকজন আত্মীয় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া খুবই সহজ ছিল। কিন্তু এখন ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই দেশে আমার কয়েকজন আত্মীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারাও এখন সমস্যায় আছেন। অনেকেই আত্মগোপন করে আছেন, কেউ কেউ বিদেশে পালিয়েছেন।
বাংলাদেশের ওই আত্মীয়দের কেউ কেউ হুসেইনকে ফোন করে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা এখন খুবই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বিএনপি আর জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলেও নাজমুল হুসেইনকে জানিয়েছেন তার আত্মীয়রা।
ত্রিপুরার প্রায় ৩৭ লাখ নাগরিকের মধ্যে তিন লাখেরও বেশি মুসলমান। অন্যদিকে ২২ লাখেরও বেশি বাংলাভাষী হিন্দু। তাদের বহু আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশের বাসিন্দা।
• বাংলাদেশের চাষিদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ
আন্তর্জাতিক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে যেসব কৃষকের চাষের ক্ষেত রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে গেলে বিএসএফের অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। সামরুরপাড় গ্রামের বাসিন্দা দুলালের কথায়, অনেক বছর ধরে এটাই নিয়ম, বিএসএফের কাছে পরিচয়পত্র দেখিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে যেতে হয়। কিন্তু এখন বিএসএফ খুব কড়াকড়ি করছে।
বিকেল পাঁচটায় অন্ধকার হওয়ার আগেই ওদিক থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। চাষের ক্ষেতে তো বাংলাদেশের দিক থেকেও কৃষকরা আসে। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই আমাদের। আগে তো একে অপরের সঙ্গে কথা বলতাম, খবরাখবর নিতাম। এখন সব বন্ধ, বলন দুলাল।
একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা গুলাব আলী পুরোনো সম্পর্কগুলোর কথা মনে করে বলছিলেন, আমার বয়স ৭০ বছর হলো। এরকম পরিস্থিতি আগে কখনও দেখিনি। যে প্রতিবেশী দেশটার সঙ্গে আমাদের ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল, রক্তের সম্পর্ক ছিল, সেখানে বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে তো আমাদের ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। বিএসএফও আমাদের সাবধান থাকতে বলে দিয়েছে।
• কৈলাশহর সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ
ত্রিপুরার মনু নদীর পাশে কৈলাশহর বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। এই শহরের সীমান্ত বাণিজ্য বহু দশক ধরে রমরমাই ছিল। ত্রিপুরার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র এই শহর, যার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর কথিত হামলার খবর আসার পর স্থানীয় কিছু সংগঠন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
গত ২৭ নভেম্বর থেকে ত্রিপুরার কৈলাশহরে স্থানীয় হিন্দু সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। ওই দিনই তারা চাতলাপুর শুল্ক স্টেশনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। তারপর ২০ দিনের জন্য সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কৈলাশহর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট গৌড় চন্দ্র অধিকারী বলেন, এই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ৬০-৭০ লাখ ভারতীয় টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
‘‘এই স্থলবন্দর দিয়ে যা বাণিজ্য হয়, তা থেকে ত্রিপুরার দ্বিতীয় সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হয়। প্রতি মাসে এখান থেকে সরকার দেড় থেকে দুই কোটি ভারতীয় টাকার রাজস্ব পায়। কিন্তু বিক্ষোভের পর থেকে ২০ দিন সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে,’’ বলেন অধিকারী।
ডিসেম্বরের শেষার্ধে স্থলবন্দর আবার খুললেও ব্যবসা-বাণিজ্যের হার প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলেও জানান তিনি।
• সীমান্তে কড়া পাহারা
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তার মধ্যেই উনকোটি জেলা পুলিশ দাবি করছে, সীমান্তে বিএসএফের সঙ্গে পুলিশও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।
জেলার এসপি কান্তা জাঙ্গির বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের যে ৭৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার ওপর নজর রাখার জন্য বিএসএফের ২০টি চৌকি রয়েছে। যখন থেকে বাংলাদেশে অশান্তি শুরু হয়েছে বা তারও আগে থেকেই আমরা বিএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়েই সীমান্ত প্রহরা দিই। নাইট পেট্রলিং চলতে থাকে, ফ্ল্যাগ মার্চও করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্তে টহল আরও বাড়ানো হয়েছে।
সীমান্তে অবস্থিত গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে এসপি কান্তা জাঙ্গির বলছিলেন, আমরা গ্রামবাসীদের সচেতন করার জন্য কিছু কর্মসূচি নিয়েছি। তাদের ভয় কাটানোর জন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমের ওপরও নজর রাখা হচ্ছে। কেউ সেখানে কোনও সাম্প্রদায়িক পোস্ট দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটা ডিলিট করাচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে সামরুরপাড়ের দিলীপ দাস একদিকে যেমন বাংলাদেশে তার আত্মীয়দের জন্য উদ্বেগে আছেন, আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন কালারকান্দির নাজমুল হুসেইন।
এসএস