পাকিস্তানে পাঠ্যবই ‘ইসলামিকরণের’ উদ্যোগ

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন ইমরান খানের সরকার। তবে সমালোচকরা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়ে বলছেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ পদক্ষেপের কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের কয়েক বছর পর থেকেই পাকিস্তানে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। এই প্রবণতা ১৯৫০ এর দশকে কিছুটা বেড়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর দশকে ক্রমান্বয়ে আরও বাড়তে শুরু করে।
তবে ১৯৮০ এর দশকে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের সময়ে তা ব্যাপকতা পায়। ১৯৮৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বৈরশাসক জিয়াউল হক পাঠক্রমের ‘ইসলামিকরণই’ শুধু করেননি, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইসলামি আইন কার্যকর করেছেন। বিচারবিভাগ আর সরকারি চাকরিতে ইসলামপন্থিদের নিয়োগ দিয়েছেন, সারা দেশে ইসলাম শিক্ষার প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন কয়েক হাজার।
তবে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের দাবিও বরাবরই উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে। বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করার দাবিও উঠেছে বারবার। কিন্তু ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ঠ কোনো সরকারই সংস্কারের সিদ্ধান্ত কখনো নেয়নি।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফ ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করার অঙ্গীকার করে। আশা করা হয়েছিল, এর মাধ্যমে পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলার অধিকতর প্রযোজ্য বিষয়গুলোর গুরুত্ব বাড়বে।
কিন্তু ২০১৯ সালে ইমরান খানের সরকার যে পরিকল্পনা ঘোষণা করে, তাতে ধরা পড়ে উল্টোচিত্র। তাতে দেখা যায়, পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত সাবেক ক্রিকেটার ও ‘প্লেবয়’ খ্যাত ইমরান খান পাঠক্রমে ধর্মের প্রভাব আরও বাড়ানোর পথেই হাঁটছেন।
করোনা সংকটের কারণে এতদিন নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘একমুখী’ করার কাজ দৃশ্যত শুরু হয়নি। তবে অচিরে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই ছাপার কাজ শেষ। সেখানে ইংরেজি, উর্দু, সামাজিক শিক্ষাসহ সব বিষয়েই ইসলামিকরণের জোর প্রয়াস দেখতে পাচ্ছেন দেশটির শিক্ষাবিদরা।
জানা গেছে, প্রথম ধাপে প্রাথমিক শিক্ষায় মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরান পুরোপুরি পাঠ করা বাধ্যতামূলক করা হবে। সঙ্গে নামাজ পড়া ও বেশ কিছু হাদিস মুখস্থ করানোরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব পরিকল্পনা কার্যকর করতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত দু’জন সনদপ্রাপ্ত হাফেজকে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।
ইসলামাবাদভিত্তিক শিক্ষাবিদ আব্দুল হামিদ নায়ার মনে করেন, ইমরান খান সরকারের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো ইসলামিকরণের এ উদ্যোগ সমাজে জাতিগত বিভেদ আরেও বাড়াবে এবং এখনো দেশের মধ্যে যতটুকু জাতিগত বৈচিত্র্য বিদ্যমান রয়েছে তা আরও কমাবে।
ইসলামাবাদের নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট পারভেজ হুদভয় বর্তমান সরকারের উদ্যোগকে ‘অভূতপূর্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, এটা আসলে জেনারেল জিয়াউল হকের সময়কার ইসলামিকরণের প্রয়াসকেও ছাড়িয়ে যাবে।
লাহোরের মানবাধিকারকর্মী পিটার জ্যাকব বলেন, ইমরান সরকার পাঠক্রমের শতকরা অন্তত ৩০ ভাগ ইসলামি ‘কন্টেন্ট’ রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে অনেকেই এর বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
সরকারদলীয় এমপি মুহাম্মদ বশির খান অবশ্য মনে করেন, ‘আদর্শগতভাবে পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র, তাই এখানেও ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।’
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন যে, ‘আমার মনে হয়, আমাদের সিলেবাসকে এখনো পুরোপুরি ‘ইসলামি’ করা হয়নি। আমাদের পাঠক্রমের আরো ইসলামিকরণ প্রয়োজন।’
‘বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের’
পাকিস্তান সরকারের এমন পদক্ষেপের সমালোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। অর্থনীতিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মুখে বাংলাদেশের প্রশংসা অতীতে বেশ কয়েকবারই শোনা গেছে আগে।
বাংলাদেশের প্রশংসা করে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) দলের এমপি কিশোয়ার জেহরা ইমরান খান সরকারের শিক্ষানীতির কঠোর সমালোচনা করে বলছেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে উৎসাহিত করা হয়। তাই আমাদের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা উচিত।’ কিশোয়ার জেহরার দল এমকিউএম ইমরান খান সরকারের জোটসঙ্গী।
এএস