কেন বাংলাদেশে রেল প্রকল্প স্থগিত করল ভারত, আবার শুরু করবে?

বাংলাদেশে রেল প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপির অর্থায়ন স্থগিত করেছে ভারত। গত রোববার দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্য দ্য হিন্দুর বরাতে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য জানায়।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে (সেভেন সিস্টার্স) যুক্ত করা। তবে এ মুহূর্তে এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নয়াদিল্লি বিকল্প (নেপাল-ভুটানে রেল সংযোগ) ভাবছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অপর সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি আজ মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য নিয়ে যে কথা বলেছেন এবং চীনকে এই অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন, এরপর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এরপর ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে এবং বাংলাদেশ স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটি বর্তমান ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারমধ্যে এই অঞ্চলে চীনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়ানোর আহ্বানটিও রয়েছে।
ভারত প্রকল্প স্থগিত করায় আখাউড়া-আগরতলা, খুলনা-মোংলা এবং ঢাকা-টঙ্গি-জয়দেবপুর প্রকল্পে প্রভাব ফেলবে।
আখাউড়া-আগরতলা আন্ত-সীমান্ত সংযোগ প্রকল্প
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। যারমধ্যে রয়েছে ত্রিপুরার আগরতলার নিশ্চিন্তপুর ও বাংলাদেশের আখাউড়ার গঙ্গাসাগর স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পটি।
এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে আন্ত-সীমান্ত বাণিজ্য বাড়তে বলে এনডিটিভি দাবি করেছে। এছাড়া এরমাধ্যমে ঢাকা হয়ে আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় বহুলাংশে হ্রাস পেত। এটি সম্পূর্ণ শেষ হলে আগরতলা থেকে কলকাতায় যেতে মাত্র ১২ ঘণ্টা সময় লাগবে। যেখানে এ মুহূর্তে লাগে ৩৬ ঘণ্টা। এছাড়া সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ সিলিগুঁড়ি করিডর (চিকেন নেক) ব্যবহারও প্রয়োজন হতো না। বর্তমানে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে যেসব ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন যায় তার সবই চলাচল করে সিলিগুঁড়ি করিডর দিয়ে।
মোংলা বন্দর-খুলনা প্রকল্প
অপরদিকে মোংলা-খুলনা রেল প্রকল্প ওইদিকে আরও সুবিধা এনে দিত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে মোংলা বন্দর থেকে খুলনা পুরোটা ব্রডগেজ রেললাইনের আওতায় চলে আসবে। আর মোংলা বন্দরে বর্তমানে ভারতের একটি টার্মিনাল পরিচালনার অধিকার রয়েছে। যেটির আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পরিবহণের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মোংলা উভয় বন্দরে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা রয়েছে। যেটির মাধ্যমে তারা উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে শিলিগুঁড়ি করিডর ব্যবহার ছাড়াই পণ্য পরিবহণ করতে পারছে।
অপরদিকে ঢাকা-টঙ্গি-জয়দেবপুর রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প ঢাকা কেন্দ্রিক সুবিধা এনে দিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন ভারত প্রকল্প স্থগিত করল?
এনডিটিভির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে জোরারোপ করার পর ভারতীয় কিছু বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করা শুরু করেন, ভারত কী বাংলাদেশে অর্থায়ন অব্যাহত রাখতে পারবে। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত বাধার মুখে পড়বে।
চীনের সঙ্গে রেল প্রকল্প নিয়ে ড. ইউনূসের আলাপ
এনডিটিভি জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার চীন সফরে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে রেলের উন্নয়ন এবং চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ নিয়ে আলাপ করেন। সংবাদমাধ্যমটি আরও বলেছে, চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। আর বাংলাদেশে চীনের রোড ও রেলখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়টিও প্রভাব রেখেছে বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ভারতের কাছে অন্য কোনো উপায় আছে?
প্রকল্পের কাজ তারা আবার শুরু করবে?
স্থগিত প্রকল্পের কাজ ভারত আবার শুরু করবে কি না সেটি এনডিটিভির প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়নি। তবে এ মুহূর্তে ভারত তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে রেলের ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং নেপাল ও ভুটান দিয়ে বিকল্প পথ তৈরির পরিকল্পনার ব্যাপারে ভাবছে। যদিও ওই দিকটায় তাদের ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যদি এমন (ভারত-বিরোধী) পরিস্থিতি থাকে তাহলে ভারতকে বিকল্পই ভাবতে হবে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ কমেছে বলে উভয় দেশ স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে এনডিটিভি। আর এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ের মতো প্রকল্পের কাজ চালানো সম্ভব নয়। এনডিটিভি আরও দাবি করেছে, বাংলাদেশ সরকারও ভারতকে এ প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেনি। এ কারণে এখন এটি স্থগিত করাই সবচেয়ে ভালো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্র: এনডিটিভি
এমটিআই